গর্ভাবস্থা একজন নারীর জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ যার মাধ্যমে তার মা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়। স্বপ্ন পূরণের এই জার্নিতে একটি সুস্থ বাচ্চার জন্ম দেওয়ার প্রত্যাশা সব মা করেন। আর এই প্রত্যাশা পূরণের একটি প্রচেষ্টা হতে পারে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা। কারণ এই উপাদানটি গর্ভস্থ শিশুর গঠনগত ত্রুটি প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ফলিক অ্যাসিড কি, গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিডের ভূমিকা বা উপকারিতা কতটুকু, ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার ডোজ বা মাত্রা সম্পর্কিত নির্দেশনা সহ প্রাকৃতিক উৎস বা খাবার সম্পর্কে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
ফলিক এসিড কি?
ভিটামিন বি এর মোট ৮টি প্রকরণ রয়েছে যার মধ্যে একটি হলো ভিটামিন বি৯ বা ফোলেট। আর এই ফোলেটের কৃত্রিম ধরন হলো ফলিক অ্যাসিড (Folic acid) যা শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভূমিকা রাখে। কোষ বিভাজন, লোহিত রক্ত কণিকা উৎপাদন এবং কোষের DNA উৎপাদন ও মেরামত করার কাজে ফলিক অ্যাসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গর্ভাবস্থায় ফলিক এসিডের উপকারিতা কি?
গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিড সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করে থাকে তা হলো গর্ভস্থ শিশুর স্বাভাবিক গঠন ও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করা। গর্ভাবস্থার প্রথম মাসেই স্পাইনাল কর্ড ও মস্তিষ্কের গঠন শুরু হয়। এই সময়ে মায়ের শরীরে ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি থাকলে স্নায়ুতন্ত্রের গঠনগত ত্রুটি হতে পারে যাকে মেডিকেলের ভাষায় Neural tube defects বলা হয়। এই রোগের দুইটি ধরন রয়েছে। যথাঃ
- Spina bifida: তুলনামূলক বেশি হারে হয়ে থাকে যার ফলে বাচ্চার স্পাইনাল কর্ডের গঠন ঠিকমতো হয় না। এতে করে বাচ্চার শরীর প্যারালাইসিসের মতো হয়। অর্থাৎ শিশু অচল অবস্থায় বেঁচে থাকে।
- Anencephaly: মস্তিষ্কের গঠন অসম্পূর্ণ থাকে যা বিরল হারে হতে দেখা যায়। সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত শিশু বেশিদিন বেঁচে থাকে না।
গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার প্রধান উপকারিতা হলো Neural tube defects রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে। এর পাশাপাশি আরো যেসব উপকারিতা বয়ে আনতে পারে তা হলোঃ
- ঠোঁট কাটা ও তালু কাটা সমস্যা নিয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করার ঝুঁকি কমায়
- জন্মগত হার্টের গঠনগত ত্রুটি (Congenital heart defects) নিয়ে জন্মগ্রহণ করার ঝুঁকি কমায়
- গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগেই বাচ্চা প্রসব (Premature birth) হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়
- কম ওজন নিয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করে না। অর্থাৎ শিশুর ওজন ঠিক থাকে
- মিসক্যারিজ বা গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়
- জরায়ুর ভেতরে শিশুর স্বাভাবিক গঠন যথাযথভাবে হয়।
আমাদের দেশে অধিকাংশ নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভকালীন সময়ে রক্তস্বল্পতা দেখা যায় যার একটি কারণ হলো ফলিক অ্যাসিডের অভাব। গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। যেমনঃ
- প্রি-এক্লাম্পসিয়া (Preeclampsia)
- হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক
- উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension)
- কোলন ক্যান্সার ও ব্রেস্ট ক্যান্সার
- আলজেইমার্স ডিজিজ ইত্যাদি
কতটা ফলিক অ্যাসিড নেওয়া উচিত?
গর্ভবতী নারীদের জন্য ফলিক অ্যাসিড গ্রহণের ব্যাপারে নির্দেশনা হলোঃ (Watson, 2022)
- গর্ভাবস্থার পূর্বে প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিদিন ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করতে হবে।
- গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস নূন্যতম ৪০০ মাইক্রোগ্রাম প্রতিদিন।
- চার মাস থেকে পরবর্তী ৯ মাস পর্যন্ত প্রতিদিন ৬০০ মাইক্রোগ্রাম।
- শিশুকে বুকের দুধ পান করানোর সময়ে প্রতিদিন ৫০০ মাইক্রোগ্রাম।
এটি একটি সাধারণ নির্দেশনা। তবে বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় ডোজের পরিবর্তন হতে পারে।
কার জন্য কতটুকু পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে সেই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পেতে একজন গাইনী ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
নিচে উল্লেখিত ক্ষেত্রগুলোতে তুলনামূলক বেশি পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। যেমনঃ (McDermott, 2020)
- ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত নারী
- পরিপাকতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত নারী (Sickle cell disease)
- যারা কিডনি বা লিভারের রোগে ভুগছেন
- যেসব নারীদের ক্ষেত্রে মদ্যপানের অভ্যাস রয়েছে
- যাদের পূর্বে একটি বাচ্চা Neural tube defects আক্রান্ত হয়েছে
- মৃগী, হাঁপানি, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, লুপাস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও সোরিয়াসিস রোগে আক্রান্ত এবং এর জন্য নিয়মিত ওষুধ সেবন করছেন এমন নারী।
গর্ভাবস্থায় ফলিক এসিড খাওয়ার নিয়ম
গর্ভাবস্থার একদম প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। পিরিয়ড মিস হওয়া, বমি বমি ভাব, তলপেটে ফোলাভাব ইত্যাদি লক্ষণ দেখে গর্ভধারণ হয়েছে বলে যতদিনে ধারণা করা হয় ততদিনে ইতিমধ্যে গর্ভস্থ শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের গঠন কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। তাই গর্ভধারণের পূর্বে থেকেই প্রস্তুতি হিসেবে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উত্তম।
গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের কিছু সাধারণ নিয়ম হলোঃ
- গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে সকাল বেলায় বমি বমি ভাব ও বমি হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এই সময়ে ওষুধ খাওয়া যাবে না। কারণ তা বমির মাধ্যমে শরীর থেকে বেড়িয়ে যাবে।
- চিকিৎসকের নির্দেশনা মোতাবেক প্রতিদিন একই সময়ে ওষুধ খেতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ বন্ধ করা যাবে না।
- সাধারণত কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তবে কারো ক্ষেত্রে এলার্জিক রিয়েকশান অথবা অন্য কোনো জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
ফলিক অ্যাসিডের খাদ্য উৎস
ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাদ্য উৎস হলো দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, মাছ, ডিম, গরুর মাংস, মুরগির মাংস, কলিজা, সামুদ্রিক খাবার, মটরশুটি, শিম, বাঁধাকপি, লেটুসপাতা, পালংশাক, লেবু, কমলা, মাল্টা, আঙ্গুর, বাদাম ইত্যাদি।
সবজি যত কম সময় রান্না করা যায় ততই ভালো। কারণ তাপের ফলে ভিটামিন নষ্ট হয়ে যেতে থাকে।
গর্ভাবতী নারীদের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের তুলনায় ফলিক অ্যাসিডের চাহিদা বেশি থাকে কিন্তু সেই হিসেবে খাবার খাওয়া হয়ে উঠে না। শুধুমাত্র খাবার থেকে চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিত।
ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট খুব সহজলভ্য একটি উপাদান কিন্তু গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে গর্ভস্থ শিশুর জন্য জটিল একটি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে থাকে। তাই এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে সবার জন্যই গর্ভধারণ করার আগে থেকে শুরু করে গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের নির্দেশনা মতো ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
Bibliography
McDermott, A. (2020, 10 12). Folic Acid and Pregnancy: How Much Do You Need? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/pregnancy/folic-acid
Watson, S. (2022, August 12). Folic Acid and Pregnancy. Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/baby/folic-acid-and-pregnancy
Last Updated on October 31, 2023
Leave A Comment