আমাশয় খুব কমন একটি রোগ যা যেকোনো বয়সের মানুষের হতে পারে। তবে বড়দের তুলনায় ছোটদের ক্ষেত্রে আমাশয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যায়। আমাশয় একটি জীবাণু ঘটিত রোগ যা একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্যান্য সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে।  

এই অনুচ্ছেদে আমাশয় রোগের কারণ, ধরন, লক্ষণ, চিকিৎসা পদ্ধতি, জটিলতা এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও আমাশয় রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ সম্পর্কে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

আমাশয় কি? (Dysentery meaning in Bengali)

ডিসেন্ট্রি (Dysentery) একটি ইংরেজি শব্দ যার বাংলা প্রতিশব্দ হলো আমাশয়। ডিসেন্ট্রি পরিপাকতন্ত্রের একটি রোগ যা ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবীর সংক্রমণের ফলে হয়ে থাকে। পেট ব্যথা, শ্লেষ্মা (মিউকাস) বা রক্তসহ পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডিসেন্ট্রি বা আমাশয় বলা হয়। 

আমাশয় রোগের কারণ

আমাশয় রোগের কারণ হলো জীবাণুর সংক্রমণ যা মূলত রোগাক্রান্ত ব্যক্তির মল থেকে বিভিন্ন উপায়ে সুস্থদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে। (Buff, 2018)

  • মাছির মাধ্যমে মল থেকে খাবার দূষিত হতে‌ পারে। অর্থাৎ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করার ফলে মলের উপর মাছি বসতে পারে। অতঃপর সেই মাছি খাবারে (খাবার ঢেকে রাখা না হলে) বসার সুযোগ পেলে মাছির শরীরে লেগে থাকা জীবাণু খাবারে মিশে যায়। 
  • রোগাক্রান্ত ব্যক্তির মল পুকুর বা নদীর পানিতে মিশলে এবং সেই পানি বিশুদ্ধ না করেই পান করা হলে পানির মাধ্যমে জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে।  
  • রোগাক্রান্ত ব্যক্তি মলত্যাগের পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত না‌ ধুয়ে খাবার স্পর্শ করলে খাবার দূষিত হয়‌। এছাড়াও অপরিষ্কার হাত দিয়ে সুস্থ ব্যক্তিদের স্পর্শ করার মাধ্যমে জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে।‌ 

মোটকথা, মলত্যাগ ও খাবার বিষয়ক স্বাস্থ্যবিধি না মানার ফলে আমাশয়ের সংক্রমণ হয়ে থাকে।‌ 

যেমনঃ খোলা স্থানে মলত্যাগ করা, মলত্যাগের পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত‌ না ধোয়া, পুকুর ও নদীর পানি না ফুটিয়ে (বিশুদ্ধ না করে) পান করা, খাবার ঢাকনা দিয়ে ঢেকে না রাখা ইত্যাদি।‌ 

আমাশয় রোগের লক্ষণ

আমাশয় রোগের লক্ষণ হলো ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হওয়া এবং মলের সাথে রক্ত বা মিউকাস নিঃসরণ হয়। এছাড়াও পেট ব্যথা, জ্বর, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, শরীরে‌ পানি স্বল্পতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।‌ 

আমাশয়ের ধরন

আমাশয় দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ

  • ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি (ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ) 
  • অ্যামিবিক ডিসেন্ট্রি (প্যারাসাইট বা পরজীবীর সংক্রমণ)

কিভাবে আমাশয় ডায়াগনসিস করা হয়? 

সাধারণত আমাশয় নির্ণয়ের জন্য তেমন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে না। লক্ষণ দেখে আমাশয় হয়েছে কিনা তা বোঝা যায়।‌

তবে আমাশয়ের ধরন ও জীবাণু সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য মল পরীক্ষা করতে হয়।

কিভাবে আমাশয়ের চিকিৎসা করা হয়? 

আমাশয়ের ফলে শরীর থেকে লবণ ও পানি বেরিয়ে যায়।‌ তাই আমাশয়ের রোগীর প্রধান চিকিৎসা হলো খাবার স্যালাইন খাওয়া। 

খাবার স্যালাইনের প্যাকেটের গায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী গুলিয়ে খেতে হবে। নির্দেশিত পরিমাণের চেয়ে কম বা বেশি পানিতে স্যালাইন গুলানো উচিত নয় এবং স্যালাইন গুলিয়ে ১২ ঘন্টার বেশি রাখা যাবে না।

রোগীকে যতটা সম্ভব বিশ্রামে থাকতে হবে এবং স্বাভাবিক খাবার খেতে হবে। বিশেষ করে তরল জাতীয় খাবার বেশি বেশি খেতে হবে। যেমনঃ ডাবের পানি, ফলের রস, শরবত, স্যুপ ইত্যাদি। এছাড়াও ভাত, রুটি, মাছ, ডিম, মুরগির মাংস, বাদাম, ডাল, ফলমূল, শাকসবজি, ইয়োগার্ট ইত্যাদি খেতে‌ হবে। 

ফাস্টফুড, পটেটো চিপস, কোমল পানীয়, অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।

আমাশয় রোগের জীবাণু ধ্বংস করার জন্য ওষুধ সেবন করতে হয়। এছাড়াও জ্বর, পেট ব্যথা ও বমি দূর করার জন্য ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। জ্বর নিরাময়ের জন্য প্যারাসিটামল (Paracetamol) ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট দিনে ৩ থেকে ৪ বার (৬ ঘন্টা অন্তর অন্তর) সেবন করতে হবে।

আমাশয় রোগের এলোপ্যাথিক ঔষধের নাম

আমাশয় রোগের চিকিৎসা হিসেবে সবচেয়ে কমন যে ওষুধটি ব্যবহার করা হয় তা হলো মেট্রোনিডাজল (Metronidazole) যা আমাশয়ের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবী ধ্বংস করতে সক্ষম।  

মেট্রোনিডাজল হলো একটি এন্টি-বায়োটিক যা আমাদের দেশে নিম্নলিখিত নামে কিনতে পাওয়া যায়।

  • Amirid®
  • Amobin®
  • Amodis®
  • Amotrex®
  • Anamet®
  • Apetryl®
  • Benmet®
  • Metra®
  • Metrogyl®
  • Silmet®
  • Varizil®

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মেট্রোনিডাজল ৪০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট দিনে তিন বার (৮ ঘন্টা অন্তর অন্তর) ৫ দিন সেবন করতে হয়।

বাচ্চাদের আমাশয় রোগের ঔষধের নাম 

বাচ্চাদের জন্য মেট্রোনিডাজল সিরাপ‌ প্যাকেটের গায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী দিতে হবে। তবে সবচেয়ে উত্তম হলো চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা। ট্যাবলেটের মতো একই নামে সিরাপ কিনতে পাওয়া যায়।‌

আমাশয়ের জটিলতা

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাশয় জনিত তেমন কোনো জটিলতা দেখা যায় না। ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি সাধারণত ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তবে অ্যামিবিক ডিসেন্ট্রি ভালো হতে ১৪ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। (Cleveland Clinic, 2022)

১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে আমাশয়ের লক্ষণ দূর না হলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করা না হলে আমাশয় জনিত কারণে অকাল মৃত্যু হতে পারে। যদিও মৃত্যু হওয়া খুবই বিরল ঘটনা।‌ 

আমাশয় রোগের প্রতিরোধে করণীয়

যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মাধ্যমে আমাশয় প্রতিরোধ করা সম্ভব।‌‌ (Watson, 2022) 

  • সবসময় বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। নদী ও ট্যাবের পানি ফুটিয়ে নিতে হবে অথবা ফিল্টার ব্যবহার করে বিশুদ্ধ করতে হবে।‌  
  • ফলমূল ও সবজি কাঁচা খাওয়ার জন্য ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।‌ 
  • মলত্যাগের পর ও খাবার খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। 
  • খাবার খোলা অবস্থায় রাখা যাবে না। ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে যেন মাছি বসতে না পারে। 
  • আমাশয় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে পারলে ভালো। এছাড়াও রোগাক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্র ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

শেষ কথা

আমাশয় হলো পরিপাকতন্ত্রের একটি রোগ যা জীবাণু ঘটিত কারণে হয়ে থাকে। পেট ব্যথা, ঘন ঘন মলত্যাগ, মলের সাথে মিউকাস বা রক্ত নিঃসরণ, জ্বর, বমি বমি ভাব ইত্যাদি হলো আমাশয়ের লক্ষণ।

আমাশয় হলে খাবার স্যালাইন খেতে হবে এবং মেট্রোনিডাজল ওষুধ সেবন করতে হয়। সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য আমাশয় প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

Bibliography

Buff, S. (2018, September 03). What Is Dysentery and How Is It Treated? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/digestive-health/dysentery

Cleveland Clinic. (2022, 08 15). Dysentery. Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/23567-dysentery

Watson, S. (2022, November 14). Dysentery. Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/digestive-disorders/what-is-dysentery

Last Updated on January 7, 2024