ক্যালসিয়াম হলো একটি মিনারেল উপাদান যা হাড় ও দাঁতের গঠন ও ঘনত্ব ঠিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও হার্ট, নার্ভ, রক্ত ও পেশির সুস্থতার জন্য ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন পড়ে।
ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার মাধ্যমে শরীরে ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ হয়। শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে নানাবিধ অস্বাভাবিকতা দেখা দেয় যার মধ্যে অন্যতম হলো দাঁত ও মাড়ির সমস্যা। এই অনুচ্ছেদে ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত লক্ষণ, কারণ, দাঁতের সমস্যা, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
ক্যালসিয়ামের অভাবের লক্ষণ
শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখার জন্য ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন হয়।
খাবার থেকে ক্যালসিয়ামের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ না হলে প্যারাথাইরয়েড হরমোনের প্রভাবে হাড়ে জমে থাকা ক্যালসিয়াম নিঃসরণ হতে থাকে। যার ফলাফল হিসেবে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়। (Harvard Medical School, 2023)
শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে প্রাথমিক পর্যায়ে হাড় থেকে নিঃসরণ হয় বলে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে দীর্ঘদিন ধরে অভাব হলে কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমনঃ
- পেশির শক্তি কমে যাওয়া
- হাত ও পায়ের আঙ্গুলের অবশতা
- ক্ষুধার অনুভূতি কমে যাওয়া
- অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন
- সহজেই হাড় ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা
দাঁত
দাঁতের গঠনের ক্ষেত্রে ক্যালসিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। দাঁতের সবচেয়ে শক্ত অংশের নাম হলো এনামেল (Enamel) যা দাঁতের উপরিভাগের আস্তরণ হিসেবে কাজ করে।
শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে দাঁতের এনামেল ক্ষয় হতে থাকে অর্থাৎ দাঁত ক্ষয় হয়ে যায়।
শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে মাড়ি তথা দাঁতের গোড়া দূর্বল হয়ে যায় এবং সহজেই দাঁত পড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এছাড়াও মাড়ি ফুলে যাওয়া, মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ, মাড়িতে প্রদাহ ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে দাঁত ও মাড়ির ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে দাঁতের এনামেল ক্ষয় হয়ে যাওয়া এবং সহজেই দাঁত পড়ে যাওয়ার প্রবণতার সাথে শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাবের যোগসূত্র রয়েছে।
ক্যালসিয়ামের অভাবের কারণ
ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার না খাওয়া
শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাবের অন্যতম প্রধান কারণ হলো খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার না থাকা।
বিশেষ করে যারা নিরামিষ আহার করেন অর্থাৎ প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবারগুলো খান না তাদের ক্ষেত্রে শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা যায়।
শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব
খাবার থেকে শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণের ক্ষেত্রে (Absorption) ভিটামিন ডি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতির ফলে ক্যালসিয়াম শোষণ বিঘ্নিত হয়।
ভিটামিন ডি এর প্রধান উৎস হলো সূর্য। অর্থাৎ সূর্যরশ্মি সরাসরি ত্বকে লাগলে শরীরে ভিটামিন ডি উৎপন্ন হয়। যারা রোদ পোহানোর সুযোগ পায় না তাদের শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব দেখা যায়।
বয়স ও লিঙ্গ
বয়স্কদের ক্ষেত্রে শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণের হার কমে যায়। যার ফলে ক্যালসিয়ামের অভাব হয়ে থাকে।
পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে। হরমোন জনিত প্রভাবে মহিলাদের ক্ষেত্রে এমনটি হয়ে থাকে।
অন্যান্য
- বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মায়ের বুকের দুধ পান করার ব্যাপারে অনীহা
- গর্ভকালীন সময় ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার বা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা না হলে শিশুর শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দেয়।
- দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ (Diuretic) সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
- কিডনি রোগ ও পরিপাকতন্ত্রের সার্জারির প্রভাবে শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব হতে পারে।
চিকিৎসা
ক্যালসিয়ামের অভাব জনিত দাঁতের সমস্যার চিকিৎসার জন্য একজন ডেন্টিস্ট (দাঁতের ডাক্তার) এর শরণাপন্ন হতে হবে।
দাঁতের এনামেল ক্ষয় হওয়া বা দাঁত পড়ে যাওয়ার প্রবণতা শুধুমাত্র ক্যালসিয়ামের অভাবে হয়ে থাকে বিষয়টি এমন নয়। বরং অন্য আরো অনেক কারণে দাঁত ও মাড়িতে সমস্যা হতে পারে। যেমনঃ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, মুখের ভেতর ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, শরীরে হরমোনের মাত্রা পরিবর্তন হওয়া ইত্যাদি।
আপনার ক্ষেত্রে দাঁতের সমস্যা ঠিক কেন হয়েছে তা নির্ণয় করার জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত দাঁতের সমস্যার ক্ষেত্রে চিকিৎসক ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এছাড়াও দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়। (Panoff, 2021)
- ধুমপান, মদ্যপান, তামাক ও গুল সহ সকল নেশা দ্রব্য বর্জন করতে হবে।
- সকালে ও রাতে (দিনে ২ বার) ব্রাশ করতে হবে।
- দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাবার বের করতে ডেন্টাল ফ্লস বা চিকন সুতা ব্যবহার করতে হবে।
- ৩ থেকে ৪ মাস পর পর টুথব্রাশ পরিবর্তন করতে হবে।
- টক ফল ও মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ার পরে কুলি করতে হবে।
- কোমল পানীয় পান করার ফলে দাঁতের এনামেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই কোমল পানীয় পানের অভ্যাস বর্জন করতে হবে।
প্রতিরোধ
একজন মানুষের জন্য দৈনিক ১০০০ থেকে ১২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটানোর জন্য ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ না করে বরং খাবার খাওয়া উত্তম হবে।
ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার
ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত দাঁত ও মাড়ির সমস্যা প্রতিরোধের জন্য খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। সেই সাথে উপরে উল্লেখিত পরামর্শ বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, ডিম, মাছ (বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ), বাদাম, চিয়া বীজ, মসুর ডাল, মটরশুটি, ছোলা, শিমের বিচি, শাকসবজি ইত্যাদিতে ক্যালসিয়াম রয়েছে।
ভিটামিন ডি
শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি দরকার যার চাহিদা পূরণের জন্য রোদ পোহাতে হবে। প্রতিদিন সম্ভব না হলেও মাঝেমধ্যে শরীরে সূর্যের তাপ লাগাতে হবে।
এছাড়াও প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।
ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফরাস
দাঁতের গঠনের ক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম ছাড়াও ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফরাস নামক মিনারেল উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফরাস সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে।
গম, ভূট্টা, শিমের বিচি, মিষ্টি কুমড়ার বিচি, সূর্যমুখী বীজ, অ্যাভোকাডো, বাদাম, চিয়া বীজ ইত্যাদি থেকে প্রচুর পরিমাণ ম্যাগনেসিয়াম পাওয়া যায়।
মাছ, মুরগির মাংস, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, ডাল, বাদাম ও শাকসবজি থেকে ফসফরাস পাওয়া যায়।
শেষ কথা
দাঁত ও মাড়ির সুস্থতার জন্য খাদ্যতালিকায় ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। বিশেষ করে ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি। এছাড়াও মুখগহ্বরের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং বছরে অন্তত একবার দাঁতের ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
References
Harvard Medical School. (2023, March). Calcium. Retrieved from Harvard Medical School: https://www.hsph.harvard.edu/nutritionsource/calcium/
Panoff, L. (2021, July 09). Can Calcium Deficiency Affect Your Teeth? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/calcium-deficiency-teeth
Last Updated on January 1, 2024
Leave A Comment