স্থূলতা (Obesity) বা শরীরের অতিরিক্ত ওজন বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত। যেমনঃ হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি। যারা প্রয়োজনীয় ক্যালরি চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে খাবার গ্রহণ করেন বা পরিশ্রম করেন না (ক্যালরি খরচ হয় না) তাদের ক্ষেত্রে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে দেখা যায়।
তবে এর বাইরেও কিছু কারণে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে যার মধ্যে কিছু কিছু কারণ রয়েছে যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। এই অনুচ্ছেদে শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার এমনই নয়টি কারণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
১। বংশগত ও পারিবারিক কারণ
শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে বংশগত বা জেনেটিক প্রভাব। অর্থাৎ মা বাবা বা দাদা দাদীর ক্ষেত্রে শরীরের ওজন বেশি থাকলে তাদের জিন (Genes) বংশপরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।
জেনেটিক বা জিনগত প্রভাবে বিভিন্ন রোগ হতে পারে এমনকি তা শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাড়াতে পারে। তবে পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে শরীরের ওজন বেশি থাকলে আপনার ওজন বেড়ে যাবেই এমন কোনো কথা নেই, তবে সম্ভাবনা বেশি থাকে।
গর্ভকালীন সময়ে মায়ের খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যের সাথে শিশুর ওজনের যোগসূত্র রয়েছে। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীরের ওজন বেশি থাকলে সন্তানের ক্ষেত্রে শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
২। জন্মগত কারণ
বর্তমানে নরমাল ডেলিভারির তুলনায় সিজারিয়ান ডেলিভারির (C-section) মাধ্যমে সন্তান জন্ম হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম হলে সেই সন্তানের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তবে ঠিক কি কারণে এমন হয় তা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। (Bjarnadottir, 2022)
যেসব শিশু মায়ের বুকের দুধ পান না করে বরং ফর্মুলা দুধ খেয়ে বড় হয় তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এর কারণ হতে পারে ফর্মুলা দুধ খাওয়া শিশুর অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার (Gut bacteria) ধরন বুকের দুধ খাওয়া শিশুর থেকে ভিন্ন হওয়া।
৩। অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া (Gut bacteria)
মানুষের অন্ত্রে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া থাকে যা কোনো রোগ সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে। যেমনঃ হজম, শোষণ, পুষ্টি সংশ্লেষণ, বিপাক প্রক্রিয়া ইত্যাদি।
স্বাভাবিক ওজনের মানুষ এবং অতিরিক্ত ওজন বিশিষ্ট মানুষ এই দুইয়ের মধ্যে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ধরনের ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায়। ভিন্নধর্মী ব্যাকটেরিয়া শরীরে ফ্যাট জমে যাওয়া তথা শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার সাথে সম্পর্কিত।
৪। ওষুধ বা চিকিৎসা
রোগের প্রভাবে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে। কারণ কিছু কিছু রোগের ফলে শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমে (হজম, শোষণ, মেটাবলিসম, হরমোন নিঃসরণ ইত্যাদি) অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হয় এবং এর প্রভাবে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে থাকে। যেসব রোগের কারণে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে দেখা যায় তা হলোঃ
- হাইপোথাইরয়েডিজম
- পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম যা মহিলাদের ওভারির একটি রোগ
- Cushing syndrome
- ডায়াবেটিস (Diabetes)
- Addison disease
ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে। নিচে উল্লেখিত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এমনটি হতে দেখা যায়। (Migala, 2020)
- ডায়াবেটিসের ওষুধ
- বিষন্নতা দূর করার ওষুধ
- ঘুমের সমস্যায় ব্যবহৃত ওষুধ
- স্টেরয়েড (Steroid) জাতীয় ওষুধ
- এন্টিহিস্টামিন গোত্রের ওষুধ
- মৃগীরোগ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ
- বিটা-ব্লকার (Beta-blocker)
ওজন বেড়ে যাওয়ার ভয়ে ওষুধ সেবন বন্ধ রাখা যাবে না। তবে ওষুধ সেবনের ফলে ওজন বেড়ে যেতে দেখা গেলে বিষয়টি চিকিৎসককে জানাতে হবে। চিকিৎসক ওষুধের ধরন পরিবর্তন করে দিতে পারবেন হয়তো।
৫। হরমোন
শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র খাবারের লোভ সংবরণ করতে না পারার সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং হরমোন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশেষ করে থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোনের মাত্রা কম হলে মেটাবলিসম বা বিপাক প্রক্রিয়ার গতি কমে যায় এবং এর ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে।
এছাড়াও অন্যান্য আরো যেসব হরমোনের সাথে শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে তা হলোঃ
- Insulin
- Cortisol
- Ghrelin
- Motilin
- Leptin
- Obestatin
- Estrogen
- Testosterone
- Neuropeptide Y (NPY)
- Agouti-related protein (AgRp)
- Cholecystokinin (CCK)
- Glucagon-like peptide-1
- Pancreatic peptide YY
৬। লেপটিন রেজিস্ট্যান্স
খাবার খাওয়ার পর কিছু হরমোন নিঃসরণ হয় যা পেট ভরার অনুভূতি জাগায়। এই জাতীয় হরমোনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো লেপটিন (Leptin) যা মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে সিগন্যাল পাঠায়।
খাবার খাওয়ার পরে লেপটিন হরমোন নিঃসরণ হলেও মস্তিষ্ক যদি হরমোনের প্রতি সংবেদনশীল না থাকে তবে তাকে লেপটিন রেজিস্ট্যান্স বলা হয়। এতে করে শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালরি থাকা সত্ত্বেও প্রচুর খাবার খাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।
লেপটিন রেজিস্ট্যান্স হওয়ার মূল কারণ অজানা। তবে যাদের শরীরের ওজন বেশি তাদের ক্ষেত্রে লেপটিন রেজিস্ট্যান্স হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
৭। পুষ্টি বিষয়ক জ্ঞানের অভাব
খাবারের পুষ্টিগুণ ও ক্যালরি বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকার ফলে অনেকেই শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
ভাত খেলে ওজন বেড়ে যেতে পারে শুনে অনেকেই কম ভাত খেয়ে থাকেন তবে ক্ষুধা লাগলে পাউরুটি, বিস্কুট, ফাস্টফুড অথবা সফট ড্রিংকস খেয়ে থাকেন। ভাতের চেয়ে এগুলো বেশি ক্যালরি সম্পন্ন তা জানা না থাকার ফলে এই ভুল হয় এবং এতে করে শরীরের ওজন না কমে বরং বেড়ে যায়।
অ্যালকোহল উচ্চ ক্যালরি সম্পন্ন একটি খাবার একথা হয়তো অনেকেরই অজানা। আবার বাজারে বিভিন্ন সাপ্লিমেন্ট কিনতে পাওয়া যায় যা ওজন কমাতে সহায়ক হবে বলে প্রচার করা হয়। প্রকৃতপক্ষে সেগুলো ওজন কমাতে কতটা কার্যকরী হবে সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
খাবারের ক্যালরি ও পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা উচিত। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার খেতে হবে। যেমনঃ ফাইবার সমৃদ্ধ শর্করা, ভালো মানের প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর চর্বি, পানি, ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার।
৮। জাঙ্ক ফুড
অনেকের ক্ষেত্রেই (বিশেষ করে ছোট বাচ্চা ও তরুণ তরুণী) জাঙ্ক ফুড খাওয়া একটি অভ্যাস বা নেশায় পরিণত হতে দেখা যায় যা সহজে পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না।
জাঙ্ক ফুড খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এতে প্রচুর ক্যালরি থাকে বলে শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৯। পরিবেশ
স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার ব্যাপারে পরিবেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমনঃ শহুরে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ট্রেন্ড চালু আছে যা থেকে সহজে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হয় না।
পক্ষান্তরে যারা গ্রামে বসবাস করেন তাদের ক্ষেত্রে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার প্রবণতা কম। বরং বাড়িতে খুব স্বাস্থ্যকর খাবার (সতেজ ফলমূল ও শাকসবজি) খেতে দেখা যায়।
খাবার ছাড়াও কাজের পরিবেশ ও সময় শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব রাখে। যেমনঃ অফিসে সারাক্ষণ বসে কাজ করতে হয় এমন মানুষের ক্ষেত্রে ক্যালরি কম খরচ হয়। আবার যাদের রাত জেগে কাজ করতে হয় তাদের ক্ষেত্রে শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে।
শেষ কথা
ওজন বেড়ে যাওয়ার কিছু কিছু কারণ এড়ানো না গেলেও সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার মাধ্যমে শরীরের ওজন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আপনার জন্য কেমন ডায়েট বা খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাওয়ার জন্য একজন পুষ্টিবিদের (Dietitian) শরণাপন্ন হতে হবে।
References
Bjarnadottir, A. (2022, January 19). 9 Reasons Why Obesity is Not Just a Choice. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/9-reasons-obesity-is-not-a-choice
Migala, J. (2020, October 13). 10 Common Medications That May Cause Weight Gain. Retrieved from Everyday Health: https://www.everydayhealth.com/diet-nutrition/common-medications-that-may-cause-weight-gain/
Last Updated on December 21, 2023
Leave A Comment