কর্টিকোস্টেরয়েড বা স্টেরয়েড কি?

কর্টিকোস্টেরয়েড (Corticosteroid) অথবা সংক্ষেপে স্টেরয়েড হলো এমন একধরনের ঔষধ যা কর্টিসলের অনুরূপ কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হরমোন। স্বাভাবিকভাবেই সবার শরীরে এডরেনাল‌ গ্রন্থি থাকে (দুই কিডনির উপরে) যেখান থেকে নিয়মিত কর্টিসল হরমোন নিঃসরণ হয় যা শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রাখে‌। যেমনঃ ব্লাড প্রেসার ঠিক রাখা, রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, ইলোক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখা ইত্যাদি। (Scott, 2022)

কর্টিকোস্টেরয়েড বা স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধের আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এটি খুব শক্তিশালী প্রদাহনাশক ঔষধ হিসেবে কাজ করে যা বিভিন্ন রোগের জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলায় বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধের অযাচিত ব্যবহার করা হলে তা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধের ধরণ, ব্যবহারের ক্ষেত্র সমূহ, শরীরের মধ্যে কিভাবে কাজ করে, কখন দিতে হয়, কতটা উপকারী, কি কি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং কিভাবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচা যায় সেসব বিষয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

স্টেরয়েড এর ধরণ

স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধের অনেকগুলো ধরন রয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে কমন হলো কর্টিসোন, প্রেডনিসন, মিথাইলপ্রেডনিসন, ফ্লুটিকাসন, ডেক্সামিথাসন, বিটামিথাসন ইত্যাদি। তবে এর বাইরে আরেকটি বিশেষ ধরনের স্টেরয়েড রয়েছে যার নাম হলো অ্যানাবলিক স্টেরয়েড এবং এটি সাধারণত অ্যাথলেটরা বডি ফিটনেস বাড়াতে ব্যবহার করে থাকেন। (cleveland clinic, 2020)

স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধগুলো বিভিন্ন ফর্মে পাওয়া যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ট্যাবলেট, সিরাপ, ইনহেলার, ইনজেকশন, স্প্রে, জেল, ক্রিম ইত্যাদি। কোন ফর্মে ঔষধ ব্যবহার করা হবে সেটি নির্ভর করে সমস্যার ধরন অনুযায়ী। যেমনঃ ত্বকে সমস্যা হলে বাহ্যিকভাবে ক্রিম বা জেল ব্যবহার করা হয়। আবার নাক, কান ও চোখের ক্ষেত্রে স্প্রে, হাঁটুর সমস্যায় জয়েন্টে ইনজেকশন আর শরীরের অভ্যন্তরীণ সমস্যার ক্ষেত্রে মুখে সেবন করার জন্য ট্যাবলেট অথবা শিরা/মাংসপেশিতে ইনজেকশন দিতে হবে।

স্টেরয়েড কি জন্য ব্যবহৃত হয়?

শরীরের বিভিন্ন জটিল সমস্যার চিকিৎসায় স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করা হয় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ

  • Systemic vasculitis: এটি এমন একটি জটিল সমস্যা যেখানে রক্তনালীতে প্রদাহ হয় এবং রক্তনালী সংকুচিত হতে থাকে। এর ফলাফল হিসেবে রক্তপ্রবাহে ব্যঘাত ঘটে এবং রক্তনালীর সাথে সম্পর্কিত টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • Myositis: আঘাত, ইনফেকশন অথবা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিকতার দরুন শরীরের বিভিন্ন মাংসপেশীতে প্রদাহ হলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় Myositis বলা হয়।‌
  • Rheumatoid arthritis: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভুলবশত শত্রু ভেবে শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টের টিস্যুকে আক্রমণ করার ফলে টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং লক্ষণ হিসেবে জয়েন্ট ফুলে যাওয়া সহ প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হয়ে থাকে।
  • Systemic lupus erythematosus: এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিকতার ফলে সৃষ্ট একটি জটিল রোগ যার ফলে শরীরের বিভিন্ন স্থানের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • COPD- chronic obstructive pulmonary disease: এটি শ্বাসতন্ত্রের রোগ যার ফলে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। জটিল এই রোগটিতে আমাদের দেশের অনেক মানুষ আক্রান্ত বিশেষ করে ধুমপান করেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।
  • Tuberculosis: টিবি (TB) অথবা টিউবারকিউলোসিস হলো একটি মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি যা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে হয়ে থাকে। এই রোগের জটিল অবস্থায় স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

স্টেরয়েড কখন দিতে হয়?

স্টেরয়েড খুব শক্তিশালী ঔষধ যা রোগের জটিল অবস্থার ক্ষেত্রে দিতে হয় যখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। বিশেষ করে রোগের চরম পরিস্থিতিতে রোগীর জীবন সংকটাপন্ন মনে হলে তখন এই ধরনের ঔষধ দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে থাকে। তবে অজ্ঞতা বশত অনেকেই সামান্য সমস্যার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ফার্মেসি থেকে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ কিনে খেয়ে থাকেন যা রোগ লক্ষণের দ্রুত নিরাময় করতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে শরীরের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

স্টেরয়েড কিভাবে কাজ করে?

শরীরে রোগ জীবাণুর আক্রমণ হলে তা প্রতিহত করার জন্য রক্তের শ্বেত কণিকা ও কিছু রাসায়নিক উপাদান মিলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এমতাবস্থায় প্রদাহ সৃষ্টি হয় যার মাধ্যমে শরীর বাইরে থেকে সাহায্য প্রার্থনা করে। প্রদাহের লক্ষণ হলো আক্রান্ত স্থানে ফোলাভাব, লাল হয়ে যাওয়া, ব্যথা বোধ, গরম অনুভুতি, আক্রান্ত অঙ্গের কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি। ইমিউন সিস্টেম অথবা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রভাবে প্রদাহ হয়ে থাকে যা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তবে কখনো কখনো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অতিরিক্ত প্রদাহের সৃষ্টি করে আবার ভুলবশত সুস্থ টিস্যুকে শত্রু ভেবে আক্রমণ করে বশে যার ফলে টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ শরীরে প্রদাহ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক উপাদানের নিঃসরণ কমায় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বন্ধ করে। তবে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে ফেলে যার ফলে পরবর্তীতে শরীরে রোগ জীবাণুর সংক্রমণ হলে তা যথাযথভাবে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়।

স্টেরয়েড কিভাবে উপকারী?

কখনো কখনো শরীরে এতো বেশি প্রদাহ হয় যা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সমূহ বিকল করে দিতে পারে। যেমনঃ কোনো কারণ বশত কিডনিতে অতিরিক্ত প্রদাহ হলে তা কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমতাবস্থায় স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ কিডনি সুরক্ষা করতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে তীব্র প্রদাহ নিরাময়ে অল্প মাত্রায় স্টেরয়েড গ্রহণ করা হলে তা বেশ উপকারী ভূমিকা রাখে।

স্টেরয়েড সঠিক চিকিৎসা কিনা ডাক্তার কিভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন?

স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন কোনো অপচিকিৎসা নয় বরং এটি বিজ্ঞানসম্মত এবং কার্যকারী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এই জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করতে হবে সঠিক ক্ষেত্র অনুযায়ী এবং যথাযথ মাত্রায়। অর্থাৎ যে সকল রোগের ক্ষেত্রে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ লাগবে শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে। সামান্য রোগ যন্ত্রণার ক্ষেত্রে অযাচিত ভাবে এবং নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে স্টেরয়েড সেবন করা হলে তা শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।

একজন রোগীর জন্য স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবন করা লাগবে কিনা সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য চিকিৎসক গুরুত্বের সাথে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে দেখবেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ

  • রোগীর বয়স
  • শারীরিক গঠন
  • রোগের প্রকৃতি ও তীব্রতা
  • অন্য কোনো রোগ আছে কিনা
  • অন্য কোনো ঔষধ খাচ্ছেন কিনা
  • স্টেরয়েড এর সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো কি?

স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবনের ক্ষেত্রে শরীরে নানাবিধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়ে থাকে। তবে ঔষধের ধরন, মাত্রা এবং কতদিন যাবত সেবন করা হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কম বেশি হয়ে থাকে। স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবনের ফলে সবচেয়ে কমন যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে তা হলোঃ

  • ক্ষুধা বেড়ে যায়
  • শরীরের ওজন বাড়তে থাকে
  • শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি
  • সহজেই ইনফেকশন হয়
  • মুখমণ্ডল ফুলে যায়
  • ঝাপসা দৃষ্টি
  • হাড় ক্ষয় রোগের সৃষ্টি হয়
  • ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ
  • অস্থিরতা দেখা যায়
  • ঘন‌ ঘন মেজাজ পরিবর্তন
  • ঘুমের সমস্যা হয়
  • শরীরে পানি জমে যায় ইত্যাদি

প্রত্যেকেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়?

স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ গ্রহণের ফলে সব মানুষের ক্ষেত্রে একই রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাবে এমনটি নয় বরং ব্যক্তি ভেদে পার্থক্য হতে পারে। এছাড়াও কম মাত্রায় ঔষধ সেবন করা হলে সেক্ষেত্রে সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে আবার অনেকের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।‌ তবে স্থূল মাত্রায় (বেশি পরিমাণে) এবং দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড সেবন করা হলে উল্লেখিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলো সহ নানাবিধ জটিল সমস্যা সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায় বলে সহজেই রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।

স্টেরয়েডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কীভাবে কমানো যায়?

ঔষধ সেবন করার উদ্দেশ্য হলো সুস্থ হওয়া কিন্তু এর পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কতকগুলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবন করা হলে বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে যা কমানোর জন্য নিচে বর্ণিত বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে। যেমনঃ

  • যেসব রোগের ক্ষেত্রে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ দরকার হবে শুধুমাত্র সেসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা। এর বাইরে অযাচিত ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • ঔষধ চলাকালীন সময়ে রোগীকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে যেন জটিল কোনো সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে কিনা সেই বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
  • যতটা সম্ভব খুব কম মাত্রায় ঔষধ সেবন করতে হবে।
  • স্থানিক সমস্যার ক্ষেত্রে বাহ্যিকভাবে ঔষধ ব্যবহার করতে হবে।
  • নিয়মিত ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস চেক করা সহ প্রয়োজনীয় টেস্ট করতে হবে।

স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ ওটিসি মেডিসিনের (OTC- over the counter) অন্তর্ভুক্ত নয় অর্থাৎ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ব্যতীত সংগ্রহ ও সেবন করা যায় না। আর তাই কখনো চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ফার্মেসি থেকে স্টেরয়েড কিনে খাবেন না।

References

cleveland clinic. (2020, January 20). corticosteroids. Retrieved from cleveland clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/drugs/4812-corticosteroids
Scott, E. (2022, August 31). What Is Cortisol? Retrieved from verywellmind: https://www.verywellmind.com/cortisol-and-stress-how-to-stay-healthy-3145080#

Last Updated on April 5, 2023