কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) খুবই যন্ত্রণাদায়ক একটি সমস্যা যা সাধারণত খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন পদ্ধতির অনিয়মের ফলে হয়ে থাকে আবার জটিল কোনো রোগের কারণেও হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য তেমন কোনো চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না বরং কতিপয় ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করার মাধ্যমে সমাধান পাওয়া যায়। এই অনুচ্ছেদে ৭ টি প্রাকৃতিকভাবে কোষ্টকাঠিন্য দূর করার ঘরোয়া উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সেই সাথে কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীদের খাবার তালিকা সম্পর্কে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিদ Emma Slattery প্রদত্ত নির্দেশনা সমূহ জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
কোষ্ঠকাঠিন্য কি?
শরীরের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী খাবার হজম ও শোষণের পর অন্ত্রের মধ্যে থাকা অবশিষ্ট অংশ পায়ুপথের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। খাবারের অবশিষ্ট অংশ অন্ত্রের মধ্যে দিয়ে ধীর গতিতে পায়ুপথের দিকে চলতে থাকলে অথবা পায়ুপথ দিয়ে বের হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে সহজে পায়খানা হয় না। সপ্তাহে ৩ বারের কম পায়খানা হলে তাকে কোষ্ঠকাঠিন্য হিসেবে ধরা হয়। আর একটানা তিন মাস পর্যন্ত মলত্যাগের এমন সমস্যা দেখা গেলে তাকে দীর্ঘমেয়াদী কোষ্ঠকাঠিন্য বলা হয়। নানাবিধ কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
- ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার কম খাওয়া
- পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান না করা
- অলস জীবন যাপন করা
- মানসিক চাপের মধ্যে থাকা
- পাইলস এবং এনাল ফিশার
- থাইরয়েডের সমস্যা
- ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
- পেশি ও স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা
- কোলন ক্যান্সার ইত্যাদি
সাধারণত বয়স্কদের ক্ষেত্রে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেশি দেখা যায়। এছাড়াও গর্ভবতী নারী এবং যারা শরীরের রক্তস্বল্পতা দূর করার জন্য আয়রন বড়ি খেয়ে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে কোষ্টকাঠিন্য হয়ে থাকে।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার উপায় কি?
কোষ্ঠকাঠিন্য হলে প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করার মাধ্যমে সুফল পাওয়া যায় তা হলোঃ (Schofield, 2017)
১. ইসবগুলের ভুসি খাওয়া
ইসবগুলের ভুসিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ রয়েছে যা অন্ত্রের মধ্যে গিয়ে পানি শোষণ করে খাবারের অবশিষ্ট অংশের সাথে মিশে নরম মল তৈরি করে। প্রতিদিন সকালে ও রাতে খাবার গ্রহণের পরে একগ্লাস পানিতে ১ থেকে ২ চা চামচ পরিমাণ ইসবগুলের ভুসি গুলিয়ে খেতে হবে। নিয়মিত ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়ে যায়। তবে মনে রাখতে হবে ইসবগুলের ভুসি পানিতে দীর্ঘসময় ধরে ভিজিয়ে রাখা যাবে না এবং পানিতে চিনি যোগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, চিনি তথা সরল শর্করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
২. সঠিক সময়ে ও সঠিক নিয়মে মলত্যাগ
মলত্যাগের বেগ হলে কখনো তা চেপে রাখা যাবে না। কারণ, এতে করে মল থেকে অন্ত্রের গায়ে পানি শোষণ হতে থাকে এবং মল শুকিয়ে যায়। আর মল যত শুকনো হয় কোষ্টকাঠিন্য তত বাড়তে থাকে। প্রতিদিন সকাল ও রাতে মলত্যাগের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এছাড়াও আপনার সুবিধামত সময়ে এবং যখন বেগ অনুভব হবে সেই মোতাবেক মলত্যাগ করতে হবে।
মলত্যাগের জন্য হাই-কমোডের তুলনায় লো-কমোড ব্যবহার করা উত্তম। কারণ তাতে মলত্যাগের জন্য শরীর উপযোগী পজিশনে থাকে। তবে একান্তই লো-কমোড ব্যবহারে অপারগ হলে সেক্ষেত্রে পায়ের নিচে একটি টুল ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও টয়লেটে বসে মোবাইল ব্যবহার ও খবরের কাগজ পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এতে করে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয় এবং দীর্ঘসময় ধরে মলত্যাগের অভ্যাস গড়ে উঠে যার ফলে পাইলস হতে পারে।
৩. ব্যায়াম করা
অলস জীবন যাপন কোষ্ঠকাঠিন্য সৃষ্টির একটি অন্যতম প্রধান কারণ। অন্যদিকে নিয়মিতভাবে ব্যায়াম করার ফলে শরীরে খাবার হজম প্রক্রিয়া ভালোভাবে সম্পন্ন হয়ে থাকে এবং অন্ত্রের পেশির কার্যক্ষমতা বেড়ে যায় যা অন্ত্রের মধ্যে মল পায়ুপথের দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতি বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা সহ শরীর ও মন সুস্থ রাখার জন্য সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট বা প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। হাঁটাহাঁটি করা, দৌড়ানো, জগিং, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, দড়ি লাফালাফি সহ যেকোনো ধরনের ব্যায়াম করা যেতে পারে।
৪. পর্যাপ্ত পানি পান
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য ফাইবার গ্রহণ করার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। কারণ ফাইবার শরীর থেকে পানি শোষণ করে নরম মল তৈরি করে। প্রতিদিন ২ থেকে ৩ লিটার পরিমাণ পানি পান করতে হবে। গ্রিন টি, ব্ল্যাক টি, শরবত, ফলের জুস ইত্যাদি এই হিসেবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।
৫. লেবুর শরবত
লেবুতে থাকা সাইট্রিক এসিড পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ানো সহ শরীর থেকে দূষিত উপাদান বের করে দেয়। একটি লেবু কেটে রস বের করে একগ্লাস পানির সাথে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে পান করা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। তবে লেবুর সাথে চিনি মেশানো যাবে না।
৬. ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ
প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে এমন খাবার গ্রহণ করার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। কারণ ম্যাগনেসিয়াম অন্ত্র থেকে পানি শোষণ করার মাধ্যমে নরম মল তৈরিতে সহায়তা করে থাকে। ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে অন্যতম হলো গাঢ় সবুজ রঙের শাকসবজি, অ্যাভোকাডো, কুমড়োর বিচি, বাদাম, তিসি, চিয়া বীজ, ডাল, মটরশুটি ইত্যাদি।
৭. কিসমিস (Raisins) খাওয়া
কিসমিস খুব মজাদার ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন একটি খাবার যা হজমের সমস্যা দূর করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিকার ও প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। পানিতে কিসমিস রাতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে খালিপেটে খাওয়ার মাধ্যমে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমাধান সহ এসিডিটি দূর করে এবং শরীরে ক্যালরি সরবরাহ করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য হলে কি খাওয়া উচিত?
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিদ Emma Slattery বলেন, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য খাবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ফাইবার। অন্ত্রের মধ্যে থাকা শরীররের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়ার জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি, অন্ত্রের মধ্যে মল পায়ুপথের দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতি বাড়ানো সহ নরম মল তৈরিতে ফাইবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই পুষ্টিবিদের নির্দেশনা অনুযায়ী একজন মহিলার জন্য দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম এবং পুরুষের জন্য ৩০ থেকে ৩৮ গ্রাম ফাইবার গ্রহণ করা উচিত। (Slattery, n.d.)
সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ফাইবার রয়েছে এমন খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আপেল, নাশপাতি, স্ট্রবেরি, কলা, অ্যাভোকাডো, গাজর, ব্রকলি, শিম, ছোলা, ওটস, পপকর্ণ, বাদাম, মিষ্টি আলু, টমেটো, ডার্ক চকোলেট ইত্যাদি। উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রায় সবগুলো খাবার থেকে কমবেশি ফাইবার পাওয়া গেলেও কোমল পানীয়, তেল ও প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার গুলোতে কোনো ফাইবার থাকে না। যারা কম ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের সাথে অভ্যস্ত তাদের জন্য খাবার তালিকায় হঠাৎ করে ফাইবারের পরিমাণ না বাড়িয়ে বরং ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে। অন্যথায় পেট ফাঁপা, তলপেটে ব্যথা ও বায়ুর সমস্যা হতে পারে।
কোষ্ঠকাঠিন্য হলে কি খাওয়া উচিত নয়?
কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য অতিরিক্ত ফ্যাট যুক্ত খাবার বর্জন করতে হবে। কারণ, ফ্যাট সহজে হজম হয় না এবং অন্ত্রের মধ্যে মল পায়ুপথের দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতি কমিয়ে দেয়। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার যেমনঃ বাটার, চিজ, চর্বিযুক্ত মাংস, প্রক্রিয়াজাত খাবার, কেক, পেস্ট্রি, চিপস, ফাস্টফুড সহ দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার যতটা সম্ভব পরিহার করতে হবে। এছাড়াও কারো ক্ষেত্রে মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করা জরুরী।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার ঔষধ
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য কতিপয় ওষুধ চিকিৎসকের নির্দেশনা ব্যতীত সেবন করা যেতে পারে যেগুলোকে ওটিসি মেডিসিন (OTC- over the counter) বলা হয়। যেমনঃ (Mayo Clinic, 2021)
- Duralax (Bisacodyl) ট্যাবলেট ৫ মিলিগ্রাম মাত্রায় দিনে একটি করে খেতে হবে। এই ওষুধটি অন্ত্রের মধ্যে মল পায়ুপথের দিকে এগিয়ে যেতে উদ্দীপনা জোগায়।
- Ezylax (Lactulose) সিরাপ টি দৈনিক ৫ মিলি মাত্রায় দিনে ১ থেকে ২ বার খেতে হবে। এই ওষুধটি অন্ত্রের গতি বৃদ্ধি করে এবং মল নরম করার মাধ্যমে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে থাকে।
- Glycerin সাপোজিটরি পায়খানার রাস্তায় প্রবেশ করালে ভেতরটা পিচ্ছিল হয় এবং মলত্যাগের বেগ সৃষ্টি করে। কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য দ্রুত ও সহজ সমাধান পেতে চাইলে সেক্ষেত্রে সাপোজিটরি ব্যবহার করা যেতে পারে।
Duralax বা Ezylax ওষুধটির যেকোনো একটি সেবন করতে হবে এবং এই ওষধ গুলো দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার না করে বরং মাঝে মধ্যে প্রয়োজন সাপেক্ষে ব্যবহার করতে হবে। কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য এগুলো ছাড়াও আরো কিছু ঔষধ রয়েছে তবে সেগুলো একজন চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী সেবন করতে হবে।
ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন, খাদ্যাভাসের পরিবর্তন এবং ওটিসি মেডিসিন সেবনের মাধ্যমে সমাধান না হলে সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী কতিপয় টেস্ট করার মাধ্যমে কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ নির্ণয় করে সেই মোতাবেক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় নানাবিধ জটিলতা যেমনঃ পাইলস, এনাল ফিশার, অন্ত্রের ভেতর মল শুকিয়ে জমা হতে থাকা সহ ইনফেকশন হতে পারে। আর তাই দীর্ঘমেয়াদী কোষ্ঠকাঠিন্য হলে অবহেলা না করে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
References
Mayo Clinic. (2021, August 31). Constipation. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/constipation/diagnosis-treatment/drc-20354259
Schofield, K. (2017, November 19). 6 Natural Constipation Remedies. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/6-natural-remedies-constipation
Slattery, E. (n.d.). Foods for Constipation. Retrieved from hopkins medicine: https://www.hopkinsmedicine.org/health/wellness-and-prevention/foods-for-constipation
Last Updated on April 12, 2023
Leave A Comment