বীটরুট (Beetroot) বা বীট নামটি এখন বেশ পরিচিত হয়ে গেছে। কিন্তু একটা সময় এই সবজিটি খুব বেশি পরিচিত ছিল না। তবে বর্তমানে অনেক রেস্টুরেন্ট বা বাসায় সালাদ হিসেবে এর ব্যবহার ভালই দেখা যায়। মানুষ ধীরে ধীরে বিটের উপকারিতা এবং অসাধারণ সব গুনাগুণ সম্পর্কে জানতে পারছে এবং খাদ্য হিসেবে আগ্রহ সহকারে বিভিন্ন উপায়ে তা গ্রহণ করছে।
বীট কে ক্যান্সার প্রতিরোধক ফল হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। এর পেছনে অবশ্য যথাযথ কারণ রয়েছে। তো চলুন, আজকের এই অনুচ্ছেদ থেকে বীটরুট বা বীটের উপকারিতা, পুষ্টিগুণ এবং বিশেষ ৬টি গুণাগুণ সম্পর্কে জানবো। সেই সাথে বীট ছাড়া আর কি কি খাবার ক্যান্সার প্রতিরোধ করে সেই বিষয়ে জানতে চেষ্টা করবো।
ক্যান্সার প্রতিরোধক ফল
বীট কে ক্যান্সার প্রতিরোধক ফল বলার কারণ হলো এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইটোনিট্রিয়েন্টস (Phytonutrients) থাকে যার ফলে এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রদাহ বিরোধী প্রতিনিধি হিসেবে মানুষের শরীরে কাজ করে এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও বীটে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে যা শিশুর জন্মগত ত্রুটি, বড়দের জন্য হৃদরোগ সহ লিভারের জটিলতা দূর করে সুস্থ থাকতে সহায়তা করে।
বিটরুট এর উপকারিতা
বিবিসি গুড ফুড (BBC Good Food) এর তালিকায় বীট কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং বেশ কিছু উপকারিতার বিষয়ে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বীটের মধ্যে ক্যালরি কম রয়েছে তবে শরীরের জন্য উপকারী পুষ্টিকর উপাদান গুলো রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। প্রতি ১০০ গ্রাম বীট থেকে মাত্র ৩৬ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায় তবে তা শরীরের জন্য অন্যান্য যেসব উপকারিতা বয়ে আনতে পারে- (Lewin, 2021)
Table of Contents
১. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
মানুষের দেহে কোলন একটি মহাসড়ক। আর এই মহাসড়কে জ্যাম মানে এক বিশাল বেদনাদায়ক যন্ত্রণা। এই মহাসড়কে যেন কোন জ্যামের সৃষ্টি না হয়, সেক্ষেত্রে বীট একজন দক্ষ ট্রাফিক সার্জেন্ট এর ভূমিকা পালন করে! বীটে ফাইবারের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে যা কোলনের বর্জ্যগুলোকে একটা নির্দিষ্ট গতিতে সরিয়ে দিয়ে কোলন ফ্রি রাখে তথা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
এছাড়াও বীটে ‘বিটাসায়ানিন’ নামক একটি বিশেষ ফাইটোকেমিক্যাল উপাদান রয়েছে যা কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। ফলে শরীর সুস্থতার এই মহাসড়কটি তথা কোলন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
২. ক্যান্সার প্রতিরোধক ফল বীট
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বীট রুটের নির্যাস বিভিন্ন ক্যান্সার যেমন- প্যানক্রিয়াস (Pancreas), স্তন, প্রস্টেট ও মুত্রথলির ক্যান্সারের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি বিভিন্ন অঙ্গে টিউমার গঠনের ঝুঁকিও হ্রাস করে। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রদাহবিরোধী উপাদান গুলো ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল দেখাচ্ছে।
৩. লিভার ভালো রাখার উপায়
খাবার গ্রহণ, বিপাক প্রক্রিয়া ও ওষুধ সেবনের ফলে আমাদের দেহের অভ্যন্তরে অনেক ধরনের বর্জ্য, দূষিত পদার্থ বা ময়লা জমা হয়। আমরা শুধু শরীরের বাহিরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকেই প্রাধান্য দেই। কিন্তু আমরা ভুলেই যাই যে, শরীরের অভ্যন্তরের অংশেও পরিষ্কার রাখার জন্য একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া দরকার। শরীরের ভেতরে জমা হওয়া এসব বর্জ্য বা দূষিত পদার্থ যদি দূর করা না হয়, তবে এ থেকে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হতে পারে। বীট লিভাবের গায়ে লেগে থাকা বিষাক্ত পদার্থকে ধ্বংস করতে সক্ষম এবং সেই সাথে তা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও শক্তিশালী করে তোলে।
৪. শিশুর জন্মগত ত্রুটির বা Birth Defects এর ঝুঁকি হ্রাস করে
প্রতি ১০০ গ্রাম বীটে প্রায় ১৫০ মাইক্রোগ্রাম ফলেট বা ভিটামিন বি৯ রয়েছে যা গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারে। এছাড়াও, বীটে রয়েছে ভিটামিন সি, পটাসিয়াম এবং ম্যাঙ্গানিজ যা শরীরের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন- মাংসপেশী, কিডনি, অগ্ন্যাশয়, স্নায়ু ও লিভারের কার্যক্ষমতা ভালো রাখতে সহায়তা করে।
৫. প্রদাহ বিরোধী হিসেবে কাজ করে
শরীরের বেশিরভাগ দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা এবং রোগ হালকা প্রদাহের সাথে সূক্ষ্মভাবে শুরু হয়। বীটে একধরনের প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদান থাকে আর তা হল ‘বিটেইন’। আপনি জানলে অবাক হবেন যে, এই এক ‘বিটেইন’- ই অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেমন- কোষ, প্রোটিন এবং প্রয়োজনীয় এনজাইমকে প্রদাহ এবং পরিবেশগত চাপ থেকে রক্ষার জন্য সশস্ত্র প্রহরী হিসেবে কাজ করে। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ সবজি হিসেবে পৃথিবীর সেরা ১০ এর মধ্যে বীট অন্যতম।
৬. উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায়
বীটের ভিতরে প্রাকৃতিকভাবেই প্রচুর পরিমাণে নাইট্রেট থাকে। আর এই নাইট্রেট কেবল কয়েক ঘন্টার মধ্যেই রোগীর উচ্চ রক্তচাপের মাত্রা কমানোর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে, এক গ্লাস বিটের জুস পানে উচ্চ রক্তচাপ কয়েক মিলিমিটার পর্যন্ত কমে যেতে পারে। ১ বীটে থাকা নাইট্রেট যখন শরীরে গিয়ে নাইট্রিক অক্সাইডে রূপান্তরিত হয়, তখন তা রক্তনালীকে শিথিল করে ফেলে এবং এতে করে শরীরের রক্ত প্রবাহ ভালো থাকে।

beetroot benefits
বীটরুট (Beetroot) / বিট ফল খাওয়ার নিয়ম
বীট আপনি যেভাবে খুশি সেভাবে খেতে পারেন। যেমনঃ উপরের চামড়া ছাড়িয়ে সালাদ হিসেবে অথবা জুস বানিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও আপনি চাইলে ভাজি করে অথবা সবজি হিসেবে রান্না করেও খেতে পারেন। তবে রান্না ও ভাজির তুলনায় কাঁচা (Raw beetroot) অবস্থায় বীট এর পুষ্টিগুণ ভালো থাকে।
সতর্কতা
বীট খাওয়ার ফলে প্রস্রাব ও পায়খানার বর্ণ কিছুটা পরিবর্তন (লাল অথবা পিংক কালার) দেখা যেতে পারে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই বরং এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তবে বেশি মাত্রায় বীটের উপকার পাওয়ার আশায় অতিরিক্ত পরিমাণে বীট খাবেন না। অতিরিক্ত বলতে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিমাণের নির্দেশনা দেওয়া নেই। তবে অন্যান্য সবজি বা ফল স্বাভাবিক ভাবে যে পরিমাণে খেয়ে থাকেন সেভাবে খাবেন। কিন্তু যাদের ইতিপূর্বে কিডনিতে পাথর হয়েছিল তাদের জন্য বীট একেবারেই না খাওয়া উত্তম। কারণ এক্ষেত্রে বীট এ থাকা অক্সালেট (oxalate) কিডনিতে পাথর সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করে যেসব খাবার

ক্যান্সার প্রতিরোধের খাবার হিসেবে আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি নিম্নলিখিত খাবারগুলোকে চিহ্নিত করেছেন- (American Society of Clinical Oncology, 2019)
✓ উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার গুলো বেশি বেশি পরিমাণে খেতে হবে। যেমনঃ সবধরনের শাকসবজি ও ফলমূল বিশেষত টমেটো, গাজর, ব্রকলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মটরশুটি, বাদাম, এবং ফলের মধ্যে কলা, আঙ্গুর, কমলা, তরমুজ ইত্যাদি। ফলমূল ও শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে থাকে।
✓ মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া যাবে। সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৫০০ গ্রাম পরিমাণ গরুর মাংস খাওয়া নিরাপদ। তবে এর বেশি পরিমাণে খাওয়া উচিত নয়।
✓ ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। পানীয় হিসেবে চা, শরবত ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। তবে অতিরিক্ত মাত্রায় কফি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
ক্যান্সার প্রতিরোধ দিবস
ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস বা বিশ্ব ক্যান্সার সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। আবার পুরো ফেব্রুয়ারি মাসকেই ক্যান্সার সচেতনতা মাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যা হোক, দিবস ও মাস পালনের মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধে আমরা সবাই সচেতন হতে চেষ্টা করবো।
বিটের উপকারিতা সম্পর্কে জানার পর অনেকেই হয়তো বীট খাওয়া শুরু করবেন যা অবশ্যই প্রশংসনীয়। সেই সাথে ক্যান্সার প্রতিরোধক খাবার হিসেবে উল্লেখিত অন্যান্য খাবার গুলোর দিকে নজর দিন। মনে রাখবেন স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপনের মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব।
References
American Society of Clinical Oncology. (2019, 5). Food and Cancer Risk. From cancer dot Net: https://www.cancer.net/navigating-cancer-care/prevention-and-healthy-living/food-and-cancer-risk
Lewin, J. (2021, 2 8). Top 5 health benefits of beetroot. From BBC good food: https://www.bbcgoodfood.com/howto/guide/ingredient-focus-beetroot/amp
Last Updated on April 27, 2023
 
			
					 
									 
	 
	 
	 
	 
	
Leave A Comment