আমাদের দেশে খুব কমন একটি খাবার হলো সজনে ডাঁটা যা আঞ্চলিক ভাষায় সাজনা নামেও পরিচিত। এটি Moringaceae পরিবারের একটি উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম হলো Moringa oleifera. সাজনা ডাঁটা কম বেশি সবাই খেয়ে থাকলেও সাজনা পাতা (Moringa leaves) খাওয়ার বিষয়টি অনেকের কাছেই অপরিচিত মনে হতে পারে। আর তাই আজকের এই অনুচ্ছেদে সাজনা পাতা খাওয়ার পদ্ধতি এবং খাওয়ার ফলে তা আপনার শরীরের জন্য কি কি উপকারিতা বয়ে আনতে পারে সেই বিষয়ে কথা বলবো।
এছাড়াও যারা ইতিমধ্যেই সাজনা পাতার গুণাগুণ জানেন এবং প্রায়ই তা বিভিন্ন উপায়ে খেয়ে থাকেন তাদের জন্যও রয়েছে বিশেষ চমক। আর তা হলো বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিতে আপনি কতটুকু সঠিক জানতে পেরেছেন তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। সেই সাথে গর্ভাবস্থায় সাজনা পাতা খাওয়া কতটা নিরাপদ তা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
সজনে পাতার পুষ্টিগুণ (প্রতি ১০০ গ্রাম অনুপাতে)
সজনে পাতাকে সুপার ফুড বলা হয় কারণ এর মধ্যে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। প্রতি ১০০ গ্রাম সতেজ (Raw) সজনে পাতা থেকে যে পরিমাণে পুষ্টি উপাদান পাওয়া যেতে পারে তা নিচে ছক আকারে উল্লেখ করা হলো: (Wikipedia, 2022)
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ |
শক্তি | ৬৪ ক্যালরি |
কার্বোহাইড্রেট | ৮.২৮ গ্রাম |
প্রোটিন | ৯.৪০ গ্রাম |
ফ্যাট | ১.৪০ গ্রাম |
ফাইবার | ২.০ গ্রাম |
পানি | ৭৮.৬৬ গ্রাম |
ভিটামিন | পরিমাণ |
ভিটামিন এ | ৩৭৮ মাইক্রোগ্রাম |
ভিটামিন বি১ (থায়ামিন) | ০.২৫৭ মিলিগ্রাম |
ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লেভিন) | ০.৬৬০ মিলিগ্রাম |
ভিটামিন বি৩ (নিয়াসিন) | ২.২২০ মিলিগ্রাম |
ভিটামিন বি৫ (প্যানটোথেনিক এসিড) | ০.১২৫ মিলিগ্রাম |
ভিটামিন বি৬ (পাইরিডক্সিন) | ১.২ মিলিগ্রাম |
ভিটামিন বি৯ (ফলেট) | ৪০ মাইক্রোগ্রাম |
ভিটামিন সি | ৫১.৭ মিলিগ্রাম |
মিনারেলস | পরিমাণ |
ক্যালসিয়াম | ১৮৫ মিলিগ্রাম |
আয়রন | ৪ মিলিগ্রাম |
ম্যাগনেসিয়াম | ১৪৭ মিলিগ্রাম |
ম্যাঙ্গানিজ | ০.৩৬ মিলিগ্রাম |
ফসফরাস | ১১২ মিলিগ্রাম |
পটাশিয়াম | ৩৩৭ মিলিগ্রাম |
সোডিয়াম | ৯ মিলিগ্রাম |
জিংক | ০.৬ মিলিগ্রাম |
সাজনা পাতার উপকারিতা
সাজনা পাতার নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৯ টি হলোঃ
১. প্রদাহ নাশক (Anti-inflammatory) এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
সাজনা পাতার মধ্যে Quercetin এবং Chlorogenic acid নামক দুইটি বিশেষ উপাদান রয়েছে যা শক্তিশালী এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতিদিন ১ চা চামচ (৭ গ্রাম পরিমাণ) সাজনা পাতার গুঁড়া ৩ মাস পর্যন্ত খাওয়ার ফলে শরীরে এন্টি অক্সিডেন্ট এর মাত্রা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। (Arnarson, 2018)
এন্টি অক্সিডেন্ট শরীরে ফ্রি রেডিক্যাল এর সংখ্যা অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে। আর ফ্রি রেডিক্যাল বেড়ে যাওয়ার ফলে প্রদাহ (Inflammation) হয় এবং হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সেই সাথে এন্টি অক্সিডেন্ট, বিটা ক্যারোটিন এবং প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি এর উপস্থিতি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। আর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া মানেই সহজেই রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
২. রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে
ডায়াবেটিস এর প্রধান সমস্যা হলো রক্তে অতিরিক্ত মাত্রায় সুগারের উপস্থিতি যার ফলে শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন হার্ট, চোখ, কিডনি, স্নায়ুতন্ত্র ইত্যাদির কার্যক্ষমতা এবং যৌন সক্ষমতা কমে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে সাজনা পাতা সরাসরি অথবা গুড়ো করে নিয়মিত খাওয়ার ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। এর কারণ হিসেবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন যে সাজনা পাতার মধ্যে isothiocyanates নামক একটি বিশেষ উপাদান রয়েছে যার প্রভাবে এমনটি হয়ে থাকে। (Arnarson, 2018)
তাই বলে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ওষুধ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সাজনা পাতার উপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। কারণ এই বিষয়ে যে গবেষণা হয়েছে সেগুলো যথেষ্ট নয় আর তাছাড়া ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য সাজনা পাতা খাওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। তবে ওষুধ সেবনের পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সহায়ক উপাদান হিসেবে সাজনা পাতা খাওয়া যেতে পারে।
৩. লিভারকে সুস্থ রাখে
লিভার মানুষের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেখানে শরীরের নানাবিধ জৈব রাসায়নিক কার্যক্রম ঘটে থাকে। আমরা প্রতিনিয়ত যে সমস্ত ওষুধ খেয়ে থাকি তার বেশিরভাগই লিভার ও কিডনির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে থাকে। বিশেষত টিউবারকুলোসিস বা টিবি (Tuberculosis) রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য নির্দেশিত anti-tubercular ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় লিভারের কোষ মারাত্বক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর সাজনা পাতা লিভারের এই ক্ষতিগ্রস্ততা কমানোর মাধ্যমে লিভারকে ভালো রাখতে সহায়তা করে। (Banerjee, n.d.)
৪. রক্তে কোলেস্টেরল কমায়
রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বা LDL (low density lipoprotein) বেড়ে যাওয়ার সাথে হার্টের রোগ যেমন উচ্চ রক্তচাপ, করোনারি আর্টারি ডিজিজ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদির ঝুঁকি বাড়তে থাকে। উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন খাবার যেমন কাঠবাদাম, তিসি, অ্যাভোকাডো ইত্যাদির মতো সাজনা পাতাও রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন সময়ে প্রাণি ও মানুষের উপর আলাদা আলাদাভাবে নানাবিধ গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে যে সাজনা পাতার মধ্যে খারাপ কোলেস্টেরল কমানোর সক্ষমতা রয়েছে।
৫. হাড় ও দাঁতের সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে
সাজনা পাতায় প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস রয়েছে যা দাঁত ও হাড়ের গঠনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। দৈনিক একজন মানুষের শরীরে যে পরিমাণ এই উপাদানগুলো প্রয়োজন পড়ে তার ১৯ শতাংশ ক্যালসিয়াম এবং ১৬ শতাংশ ফসফরাস ১০০ গ্রাম সাজনা পাতা থেকে পাওয়া সম্ভব হয়। আর তাই যারা নিরামিষাশী ব্যক্তি অর্থাৎ প্রাণিজ আমিষ জাতীয় খাবার বর্জন করে চলেন তাঁদের জন্য ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের উৎস হিসেবে সাজনা পাতা একটি ভালো খাবার হতে পারে।
৬. আর্সেনিক পয়জনিং কমায়
আমাদের দেশের অনেক জায়গায় নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় যা একপ্রকার বিষ। দীর্ঘদিন যাবত মানুষের শরীরে আর্সেনিক প্রবেশ করতে থাকলে তা একসময়ে বিষক্রিয়ার (Arsenic toxicity) সৃষ্টি করে থাকে এমনকি তা বিভিন্ন জটিল রোগ যেমন হার্টের রোগ এবং ক্যান্সারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে সাজনা পাতা ও সাজনার বীজে থাকা কিছু প্রাকৃতিক উপাদান আর্সেনিক বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করতে পারে। তবে এই ব্যাপারে একদম নিশ্চিত হওয়ার জন্য মানুষের উপর গবেষণা করা প্রয়োজন। (Arnarson, 2018)
৭. রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে
প্রতিদিন ১০০ গ্রাম পরিমাণ সাজনা পাতা খাওয়ার মাধ্যমে যে পরিমাণ ভিটামিন এ পাওয়া যায় তাতে শরীরের অর্ধেক চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। আর ভিটামিন এ রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করা সহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর (হার্ট, ফুসফুস, কিডনি) স্বাভাবিক কার্যক্রমে সহায়তা করে থাকে।
৮. প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করে
আমাদের দেশে দরিদ্র পরিবারগুলোতে ছেলেমেয়েরা প্রোটিনের অভাবে ভোগে যার ফলে তাদের শরীরে যথাযথ বৃদ্ধি হয় না। এর কারণ হলো প্রোটিনের প্রধান উৎস মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি বেশ ব্যয়বহুল যা সবার পক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণে কেনা সম্ভব হয় না। আবার শাকসবজি ও ফলমূল থেকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন পাওয়া গেলেও তা থেকে খুব বেশি প্রোটিন পাওয়া যায় না। তবে সাজনা পাতার মধ্যে ১৮ ধরনের এমিনো এসিড রয়েছে যা প্রোটিন গঠনের মূল উপাদান। সেই সাথে সাজনা পাতা খুবই সহজলভ্য একটি খাবার। আর তাই প্রোটিনের একটি ভালো উৎস হিসেবে সাজনা পাতা খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
৯. খুশকি দূর করে এবং চুল পড়া কমায়
সাজনা পাতা বেটে অথবা ব্লেন্ডারে পিষে ঘন পেস্ট তৈরি করে মাথার ত্বকে লাগানোর ফলে খুশকির সমস্যা দূর হয়ে যায়। সেই সাথে খুশকির দরুন চুল পড়ার সমস্যা থাকলে তা ঠিক হয়। এছাড়াও চুলের গোড়া মজবুত করে থাকে যা চুল পড়া ঠেকানোর আরেকটি কার্যকরী উপায়।
সজনে পাতার ঔষধি গুণ
সজনে গাছকে মিরাকেল ট্রি (Miracle Tree) বলা হয় কারণ এর সমস্ত অংশ যেমন ডাঁটা, পাতা, বাকল, শিকড় ইত্যাদি জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান এবং ভেষজ গুণাবলী।
যাদের পরিপাকতন্ত্রে বিভিন্ন (Digestive system) সমস্যা রয়েছে যেমন খাবার সহজে হজম না হওয়া, পেটে অতিরিক্ত গ্যাস জমে, বুকজ্বালা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি সমস্যা সমাধানে নিয়মিত সজনে পাতার গুঁড়া সেবন করা সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
হারবাল ও ভেষজ চিকিৎসকেরা সজনে পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে তা ডায়াবেটিস এবং হার্টের রোগীদের জন্য ব্যবহার করেন। কারণ সজনে পাতার গুণাগুণ রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে চিকিৎসার জন্য ওষুধের বিকল্প হিসেবে সজনে পাতার গুঁড়া ব্যবহার করা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান দ্বারা স্বীকৃত নয়।
সাজনা পাতা খাওয়ার নিয়ম
সাজনা পাতার উপকারিতা জানার পর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো খাওয়ার নিয়ম ও পরিমাণ জানা। যদিও এটি প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত নিরাপদ প্রকৃতির একটি খাবার তবে বেশি পরিমাণে খেলে তাতে নানাবিধ অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন:
- বমি বমি ভাব অথবা বমি
- পেটে ব্যথা (Cramping pain)
- ডায়রিয়া ইত্যাদি
সাজনা পাতা খাওয়ার পরিমাণ বিষয়ে একটি নির্দেশনা হলো শরীরের ওজন অনুযায়ী প্রতি কেজিতে ১ গ্রাম। অর্থাৎ আপনার শরীরের ওজন যদি ৬০ কেজি হয়ে থাকে তবে আপনার জন্য ৬০ গ্রাম পরিমাণ সাজনা পাতা খাওয়া যেতে পারে। কোনো অবস্থাতেই এই মাত্রা শরীরের ওজন অনুযায়ী প্রতি কেজিতে ৩ গ্রামের বেশি অতিক্রম করা উচিত হবে না। (Wikipedia, 2022)
উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েড ও ডায়াবেটিসের ওষুধ চলাকালীন সময়ে সজনে পাতা অথবা পাতার গুঁড়া খাওয়ার ব্যাপারে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে। কারণ এই সমস্ত রোগের জন্য নির্দেশিত কিছু কিছু ওষুধের সাথে সজনে পাতার মিথস্ক্রিয়া হতে পারে। যার ফলে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাওয়া বা অন্য যে কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে।
সাজনা পাতার রেসিপি
সাজনা পাতা বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া যেতে পারে। সজনে পাতা কিভাবে খেতে হয় তার কিছু জনপ্রিয় কয়েকটি রেসিপি সম্পর্কে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
সাজনা পাতার ভর্তা
সবচেয়ে সহজ একটি উপায় হলো সাজনা পাতার ভর্তা বানানো। প্রথমে গাছ থেকে কচি পাতা সংগ্রহ করে ময়লা দূর করার জন্য ভালো ভাবে ধুয়ে নিতে হবে। অতঃপর একটি পাতিলে অল্প পরিমাণে পানি দিয়ে তার মধ্যে সাজনা পাতা সিদ্ধ হতে দিন। সিদ্ধ হয়ে গেলে কুচি কুচি করে কাটা পেঁয়াজ, মরিচ এবং সামান্য একটু তেল ও লবণ মিশিয়ে ভর্তা করে ফেলুন। গরম ভাতের সাথে মিশিয়ে খেতে বেশ মজাদার লাগবে।
সাজনা পাতা রান্না
যে কোনো মাছের তরকারি অথবা শুধু সবজি রান্না করার সময় শাক হিসেবে সাজনা পাতা ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে সাজনা পাতা আলাদা ভাবে অল্প পানিতে কিছুক্ষণ সিদ্ধ করে নিতে পারেন। পরে অন্যান্য সবজির সাথে মিশিয়ে রান্না করে ফেলুন। একটি বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি আর তা হলো রান্নায় যেনো অতিরিক্ত পরিমাণে মশলা ব্যবহার করা না হয়। কারণ অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
সাজনা পাতা ভাজি
সাজনা পাতা শাক ভাজির মতো করে খেতে পারেন। প্রথমে অল্প পানিতে সিদ্ধ করে নিন। অতঃপর পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, কালোজিরা (ঐচ্ছিক), তেল, লবণ ইত্যাদি সহযোগে কড়াইতে ভাজতে থাকুন। স্বাদ বৃদ্ধি করার জন্য খুব বেশি পরিমাণে তেল ব্যবহার করা যাবে না। বরং পরিমাণ মতো তেল ও লবণের ব্যবহার করুন।
সজনে পাতার বড়া
সজনে পাতা দিয়ে বড়া বানিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথমেই সজনে পাতা বেটে অথবা ব্লেন্ডারে পিষে নিতে হবে। বড়া তৈরির জন্য সহযোগী উপাদান হিসেবে প্রয়োজন হবে ডাল যা পিষে সজনের সাথে মিশিয়ে নিতে হবে। অতঃপর তাতে লবণ, মরিচ, পেঁয়াজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ যোগ করে তেলে ভেজে নিতে হবে। মচমচে গরম বড়া খাবার হিসেবে বেশ সুস্বাদু লাগবে।
সাজনা পাতার চা
সাজনা পাতার চা দুইভাবে তৈরি করা যেতে পারে। এক. সরাসরি কাঁচা সাজনা পাতা লাল চায়ের মধ্যে মিশিয়ে খাওয়ার মাধ্যমে উপকারিতা পাওয়া যায়। দুই. এক্ষেত্রে প্রথমে সাজনা পাতা শুকিয়ে নিতে হবে। অতঃপর তা হাতের মুঠোয় নিয়ে যতটুকু সম্ভব গুঁড়া করতে হবে। এবার তা গরম পানিতে মিশিয়ে চা বানাতে হবে। এই চায়ের সাথে পরিমাণ মতো চিনি, কুচি কুচি করে কাটা আদা ও লেবু ব্যবহার করা যেতে পারে।
সাজনা পাতার গুঁড়া
সাজনা পাতা গুঁড়া করে দীর্ঘদিন ঘরে সংরক্ষণ করে রাখা যায়। এক্ষেত্রে প্রথমে পাতা সংগ্রহ করে ধুয়ে নিতে হবে। অতঃপর রোদে দিয়ে ভালো ভাবে শুকিয়ে নেওয়ার পর শক্ত কিছুর উপর রেখে পিষে অথবা গ্রিন্ডার (Grinder) মেশিনের সহায়তায় গুঁড়া করতে হবে। প্লাস্টিকের বোতল অথবা বাটিতে না রেখে কাঁচের পাত্রে রাখুন। তাতে গুনাগুণ সবচেয়ে ভালো থাকবে।
সজনে ডাঁটা বেশি পুষ্টিকর নাকি পাতা?
সজনে ডাঁটা খেতে বেশ সুস্বাদু ও জনপ্রিয় একটি সবজি। তবে পুষ্টিগুণ বিবেচনায় সজনে পাতা আর সজনে ডাঁটা দুটোই মুল্যবান। এই দুই ধরনের খাবারের মধ্যেই কিছু বিশেষ গুণাগুণ রয়েছে যা শরীরের জন্য নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনে। আর তাই আপনার পছন্দমতো যে কোনো একটি খেতে পারেন। তবে সজনে ডাঁটার মধ্যে পাতার তুলনায় বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি ও ফাইবার রয়েছে। এছাড়াও সবজি হিসেবে সজনে ডাঁটা খাওয়ার মাধ্যমে শরীরের জন্য যে সমস্ত উপকার পাওয়া যেতে পারে তা হলোঃ (Cadman, 2020)
- ওজন কমাতে সহায়তা করে
- লিভার ভালো (সুস্থ) রাখে
- কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়
- হাড়ের গঠন মজবুত করে
- ক্ষত সারাতে সহায়তা করে
- দৃষ্টি শক্তি ভালো রাখে
- রক্তস্বল্পতা দূর করে ইত্যাদি
গর্ভাবস্থায় সাজনা পাতা খেলে কি হয়?
গর্ভাবস্থায় প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও ফলেট সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। কারণ আয়রন গর্ভবতী মহিলাদের রক্তস্বল্পতা দূর করে আর ফলেট গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা কমায়। সাজনা পাতা আয়রন ও ফলেটের ভালো উৎস হলেও গর্ভাবস্থায় তা সেবন করা নিরাপদ হবে কিনা সেই বিষয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে গবেষণা হয়নি বলে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনাও নেই। তবে সাজনার শিকড় ও বাকল সেবন করা হলে তা জরায়ুর অস্বাভাবিক সংকোচন ঘটানোর মাধ্যমে গর্ভপাতের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। (Banerjee, n.d.) সুতরাং পাতা খাওয়ার ফলেও এমন কোনো জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। আর তাই গর্ভবতী মহিলা ও শিশুকে বুকের দুধ পান করান এমন মহিলাদের ক্ষেত্রে সাজনা পাতা খাওয়ার পূর্বে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ (Gynecologist) চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
সজনে পাতা নিয়ে ভুল ধারণা
সজনে পাতার গুণাগুণ সম্পর্কে ইন্টারনেটে অনেক তথ্য রয়েছে যেখানে প্রায়ই বাড়িয়ে বলা হয়েছে। যেমন: আপনি হয়তো দেখে থাকবেন অথবা শুনেছেন যে ১০০ গ্রাম সজনে পাতা থেকে যে পরিমাণ ভিটামিন সি পাওয়া যায় তা ৭ টি কমলার (Orange) সমান। আবার সজনে পাতায় এতো বেশি পরিমাণে পটাশিয়াম রয়েছে যা কলার তুলনায় ১৫ গুণ বেশি এবং দুধের চেয়ে ৪ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম রয়েছে সজনে পাতার মধ্যে। তো চলুন এই তথ্যগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করা যাক।
একদম উপরের দিকে ছকে ১০০ গ্রাম সতেজ (Raw) সজনে পাতায় বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান সমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে যে মাত্র ৫১.৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি রয়েছে। অপরদিকে ১০০ গ্রাম ওজনের একটি কমলার মধ্যে ৫৩.২ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি রয়েছে যা সজনে পাতার চেয়ে ৭ গুণ কম নয়! বরং কমলার মধ্যে থাকা ভিটামিন সি নষ্ট হয় না কারণ তা আগুনের তাপে রান্না করে খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অপরদিকে সজনে পাতা রান্না করে খেলে আগুনের তাপে ভিটামিন সি কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়। আর তাই সজনে পাতার অতিরঞ্জিত গুণাগুণ শুনে কমলা খাওয়া বাদ দিবেন না।
একইভাবে সজনে পাতার মধ্যে ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম রয়েছে যথাক্রমে ১৮৫ মিলিগ্রাম ও ৩৩৭ মিলিগ্রাম। পক্ষান্তরে ১০০ গ্রাম (অথবা ১০০ মিলিলিটার) দুধ থেকে ১২৫ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় যা সজনের তুলনায় সামান্য কম তবে তা ৪ গুণ নয়। আর ১০০ গ্রাম কলা থেকে পটাশিয়াম পাওয়া যায় ৩৫৮ মিলিগ্রাম যা সজনে পাতার চেয়ে বেশি।
সাজনা পাতা নিঃসন্দেহে একটি পুষ্টিকর খাবার তবে তা অন্যান্য সব ধরনের পুষ্টিকর খাবার ছাড়িয়ে যাবে এমনটি নয়। পথ্য বা পুষ্টিকর খাবার হিসেবে মাঝে মধ্যেই এটি খেতে পারেন তবে অতিরিক্ত পরিমাণে নয়।
References
Arnarson, A. (2018, May 4). 6 Science-Based Health Benefits of Moringa oleifera . From Healthline: https://www.healthline.com/nutrition/6-benefits-of-moringa-oleifera
Banerjee, N. (n.d.). Moringa Leaves – 16 Health Benefits That You Should Know . From Pharmeasy: https://www.google.com/amp/s/pharmeasy.in/blog/16-health-benefits-of-moringa-leaves/amp/
Cadman, B. (2020, January 2). What makes moringa good for you? From Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/319916
Wikipedia. (2022, February 7). Moringa oleifera. From Wikipedia: https://en.m.wikipedia.org/wiki/Moringa_oleifera
Last Updated on November 4, 2023
Leave A Comment