দাঁত এবং চোয়ালের আশেপাশে হালকা থেকে তীব্র ব্যথাকেই সাধারণত দাঁত ব্যাথা বুঝানো হয়। আপনার যদি দাঁতে ব্যথা সমস্যা থেকে থাকে, তা নিশ্চয়ই অন্য কোন একটা সমস্যার কারণে হচ্ছে যা একেবারে নির্মূল করার জন্য দাঁত ব্যাথা, ফোলা বা অন্য যেকোন সমস্যার মূল কারণটা খুঁজে বের করা জরুরি।
নিয়মিত হালকা কুসুম গরম লবণ পানি দিয়ে কুলকুচি করে এবং বরফ বা আইস্ক্রিম প্রয়োগে সাধারণত ছোটখাটো যন্ত্রণা প্রতিকার করা যায়। তবে তীব্র দাঁতের ব্যথার জন্য বা যদি দাঁতের ব্যাথা বা দাঁতের অন্য কোন সমস্যা এক বা দুই দিনের বেশি সময় ধরে থাকে তবে অবশ্যই অবহেলা না করে একজন ডেন্টিস্টের কাছে যাবেন সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার জন্য।
নিচে দাঁতের ব্যাথা থেকে মুক্তি পাওয়ার ৮টি ঘরোয়া প্রতিকার নিয়ে কথা বলে হয়েছে।
তবে গর্ভবতী নারী, বুকের দুধ খাওয়ান এমন নারী বা অন্য কোন রোগে চিকিৎসাধীন আছেন যা ভেষজ উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হতে এমন পরিস্থিতি হলে নিম্নলিখিত উপায়গুলোর যে কোনটি ব্যবহার করার আগে অবশ্যই একজন দাঁতের ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিবেন।
দাতের ব্যথায় করনীয়
১. লবণ পানি দিয়ে কুলকুচি
লবণ পানি একটি প্রাকৃতিক জীবাণুনাশক। নিয়মিত লবণ পানি দিয়ে কুলকুচি করলে দাঁতের মধ্যে আটকে থাকা খাবারের কণা এবং ধ্বংসাবশেষ আলগা হয়ে পানির সাথে বের হয়ে যায়। এই লবণ পানি দাঁতের ব্যথার চিকিৎসা করা ও প্রদাহ কমাতে এবং মুখের যেকোনো ক্ষত সারাতে সাহায্য করে।
ব্যবহারের নিয়মঃ এক গ্লাস পানিতে ১/২ চা চামচ লবণ মিশিয়ে মাউথওয়াশ হিসাবে ব্যবহার করুন। চাইলে হালকা কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে পারেন।
২। হাইড্রোজেন পারক্সাইড দিয়ে কুলকুচি
হাইড্রোজেন পারক্সাইড দাঁতের ব্যথা এবং প্রদাহ সারাতে সাহায্য করে। এটি ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার পাশাপাশি দাঁতের প্লেক (খাবারের কণা থেকে দাঁতে ব্যাকটেরিয়ার উপনিবেশ) কমায় এবং মাড়ির রক্তক্ষরণও বন্ধ করে।
ব্যবহারের নিয়মঃ তবে এক্ষেত্রে মিশ্রণটি সঠিক ভাবে তৈরি করতে হবে। সমপরিমাণ পানির সাথে ৩ শতাংশ হাইড্রোজেন পারক্সাইড মিশিয়ে এটি মাউথওয়াশ হিসাবে ব্যবহার করুন বা কুলকুচি করুন।
তবে এটি গিলে ফেলা যাবেনা।
দাঁত সাদা করার ঘরোয়া উপায় জানতে এখানে পড়ুন
৩। ঠান্ডা প্রয়োগ (Cold Compress)
যে কোনও জায়গায় ব্যথা পেলে ব্যাথা বা জ্বালাপোড়া দূর করতে বরফ বা ঠান্ডা ব্যবহার করলে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়, দাঁতের ব্যথার ক্ষেত্রেও তাই। বিশেষ করে ব্যাথাটা যদি কোন আঘাতের কারণে হয়ে থাকে।
ব্যাথার জায়গায় বরফ বা ঠাণ্ডা প্রয়োগের ফলে আঘাতপ্রাপ্ত জায়গার রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয় ফলে তা ব্যাথা বাড়তে বা তীব্র হতে দেয়না। এছাড়া ঠান্ডা প্রয়োগ যেকোনো ফোলাভাব এবং প্রদাহ কমাতে পারে।
ব্যবহারের নিয়মঃ ব্যাথার জায়গায়, একটি তোয়ালে কিংবা কাপড়ে বরফ পেঁচিয়ে ২০ মিনিট ধরে রাখুন। ব্যাথা থাকলে কয়েক ঘন্টা পরপর এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন।
৪। পেপারমিন্ট টি ব্যাগ
খুব সহজ এবং কার্যকরী একটি উপায় হলো পেপারমিন্ট টি ব্যাগ ব্যবহার করা। এটি ব্যথা অসাড় করতে এবং সংবেদনশীল মাড়ির জন্য ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়।
ব্যবহারের নিয়মঃ ব্যবহৃত একটি টি ব্যাগ একটু ঠান্ডা হলে আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে নিন। সামান্য উষ্ণ হলে ভালো ফল পাওয়া যায়। আর যদি ব্যাথার ধরণ অনুযায়ী ঠান্ডা প্রয়োগ করতে চান, টি ব্যাগ দিয়ে সেটিও সম্ভব। সেক্ষেত্রে ব্যবহৃত একটি টি ব্যাগ কয়েক মিনিটের জন্য ফ্রিজে রেখে তারপর ব্যাগটি একই ভাবে ব্যাথার জায়গায় লাগিয়ে নিন।
৫। রসুন
হাজার হাজার বছর ধরে, রসুন তার ঔষধি গুণাবলীর জন্য স্বীকৃত এবং ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটিতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি ডেন্টাল প্লেক সৃষ্টিকারী ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে এবং ব্যথা উপশমকারী হিসাবেও কাজ করে।
ব্যবহারের নিয়মঃ দাঁতের ব্যথায় রসুন ব্যবহার করতে, রসুনের পেস্ট তৈরি করুন এবং ব্যাথার স্থানে লাগিয়ে রাখুন। পেস্টে সামান্য লবণ মিশিয়ে নিতে পারেন। আরও সহজ উপায় হল, রসুনের একটি কোয়া ধীরে ধীরে চিবিয়ে খাবেন।
৬। লবঙ্গ
বহু প্রাচীনকাল থেকে দাঁতের ব্যথার চিকিৎসায় লবঙ্গ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লবঙ্গ থেকে প্রাপ্ত তেল ব্যথা এবং প্রদাহ কমাতে যথেষ্ট কার্যকরী। এতে ইউজেনল (Eugenol) নামক এক ধরনের যৌগ থাকে, যা প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে কাজ করে।
লবঙ্গ তেল পাতলা না করে সরাসরি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। কারণ এটি একটি এসেনশিয়াল তেল যা সরাসরি ব্যবহারে জ্বালাপোড়া কিংবা অস্বস্তি হতে পারে।
ব্যবহারের নিয়মঃ এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করতে, যেকোন ভেষজ তেল যেমন অলিভ ওয়েল, নারকেল তেল বা সূর্যমুখী তেলের সাথে লবঙ্গ তেল মিশিয়ে নিন। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ হলিস্টিক অ্যারোমাথেরাপি অনুসারে, প্রায় ১৫ ফোঁটা লবঙ্গ তেলের সাথে এক আউন্স বা ৩০ মিলিলিটার ভেষজ তেলের অনুপাতে মিশ্রণটি তৈরি করুন।
তারপরে, সামান্য তুলোর উপর অল্প পরিমাণে পাতলা তেল ঢেলে দিন এবং দিনে কয়েকবার আক্রান্ত স্থানে লাগান।
আপনি এক গ্লাস পানিতে এক ফোঁটা লবঙ্গ তেল মিশিয়েও মাউথওয়াশ তৈরি করে কুলকুচি করতে পারেন।
৭। পেয়ারা পাতা
পেয়ারার পাতায় প্রদাহ বিরোধী গুণ রয়েছে যা ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। এতে আরও রয়েছে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল কার্যকারিতা যা মুখের যত্নে উপকারী।
ব্যবহারের নিয়মঃ তাজা পেয়ারা পাতা চিবিয়ে কুলকুচি করে মুখ ধুয়ে ফেলুন বা ফুটন্ত পানিতে শুকনো পেয়ারা পাতার গুঁড়ো মিশিয়ে মাউথওয়াশ তৈরি করে নিতে পারেন।
৮। দাঁত ব্যথার ঔষধি গাছ (Toothache plant)
এই গাছটার নামই কিন্তু দাঁত ব্যথা উদ্ভিদ (Acmella oleracea) । অনেকেই এই ঔষধি গাছটা চোখে চিনে কিন্তু এর নাম কিংবা ঔষধি গুণ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। এটি একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ যা বাংলাদেশের মত গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে জন্মে। এতে একধরনের সক্রিয় যৌগ থাকে, স্পিলানথল, এবং এতে ২০২১ সালের পর্যালোচনা অনুসারে প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর পাতা কিংবা হলুদ ফুল কিছুক্ষণ চিবুলে কয়েক সেকেন্ড পরেই আক্রান্ত স্থানে অসাড় অনুভূতি হয়।
যদিও এই উদ্ভিদটিকে সাধারণত নিরাপদ বলে মনে করা হয়, তবে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা উচিত নয় (Frank, 2022)
- ভেষজ ঔষধে অ্যালার্জি থাকলে
- অ্যালকোহল পান করলে
- মূত্রবর্ধক ব্যবহার করলে
- প্রোস্টেট ক্যান্সার থাকলে
- গর্ভবতী হলে
মাত্র ৫ মিনিটে দাঁতের ব্যথা কমানোর উপায়
৫ মিনিটের মধ্যে দাঁতের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য উপরে উল্লিখিত কয়েকটি উপায় একত্রে ব্যবহার করতে হবে।
- ধাপ ১ হাইড্রোজেন পারক্সাইড বা লবণ পানি দিয়ে কুলকুচি করুন।
- ধাপ ২ আক্রান্ত স্থানে লবঙ্গ তেল বা রসুনের পেস্ট ব্যবহার করুন।
- ধাপ ৩ কোল্ড কম্প্রেস বা আইস প্যাক প্রয়োগ করুন।
এরপরও যদি ব্যথা সমাধান না হয় বা এটি গুরুতর হয়, দেরি না করে দাঁতের ডাক্তারের কাছে যান।
দাঁতের ব্যথার কারণ ও চিকিৎসা
দাঁতের ব্যাথার কারণ একজন ডেন্টিস্ট সাধারণত কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বের করে থাকেন। প্রয়োজনে তিনি এক্সরে ও করতে পারেন। আর কি কারণে ব্যাথা হচ্ছে তার উপরই নির্ভর করবে আপনাকে কি চিকিৎসা দেয়া হবে-
১. দাঁতের ক্ষয়: দাঁতে কোন গর্ত বা ক্ষয় দাঁতের ব্যথার কারণ হতে পারে। এ সমস্যায় ডাক্তার সাধারণত ফিলিং করে দাঁতের ক্ষয় বা গর্ত সারিয়ে তোলেন।
২. ফিলিং: আগেই বলা হয়েছে, দাঁতের গর্ত বা ক্ষয় সারাতে দাঁতের রঙের উপাদান দিয়ে ক্ষত জায়গাটি ফিলিং করে দেয়া হয়। তবে অনেক সময় একটি ফিলিং বিদ্যমান থাকা অবস্থায় বা পুরাতন হয়ে গেলে দাঁতের ব্যথা হতে পারে, সেক্ষেত্রে পুরাতন ফিলিং টিকে প্রতিস্থাপন করতে নতুন করে ফিলিং করা হয় ।
৩. ফোড়া (Abscess): ডেন্টাল অ্যাবসেস বা ফোঁড়া হল দাঁতের ইনফেকশন যা দাঁতের ক্ষয় বা গর্তের চিকিৎসা না করলে হতে পারে। এই সমস্যায় সাধারণত ডেন্টিস্ট অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিতে পারেন, রুট ক্যানেল করতে পারেন বা আপনার আক্রান্ত দাঁতটি ফেলে দিতে পারেন।
৪. দাঁতে দাঁত ঘষা (ব্রুকসিজম): অনেকেই ঘুমন্ত অবস্থায় বা জেগে থেকেও দাঁতে দাঁত ঘষেন। এতে দাঁত কিছুটা ক্ষয় হয়। এই কারণে যদি দাঁতে ব্যথা হয়, তাহলে আপনার ডেন্টিস্ট মাউথগার্ডের পরামর্শ দিতে পারেন।
৫. পিরিওডন্টাল ডিজিজ: যখন প্লেকের ফলে মাড়ির প্রদাহ হয়, তখন আপনার পিরিওডন্টাল রোগ হতে পারে। পিরিওডন্টাল রোগ হল মাড়ি বা চোয়ালের হাড়ের ইনফেকশন এবং প্রদাহ জনিত রোগ। এটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই মাড়ির সংক্রমণ অপসারণ করতে এবং যেন দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। (CDC, 2022)
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন?
যদি দাঁতের ব্যথা গুরুতর হয় বা বা অন্য কোন রোগের চিকিৎসা চলাকালীন এ সমস্যা দেখা দেয় তাহলে সঠিক চিকিৎসার জন্য দাঁতের ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া আবশ্যক। মনে রাখবেন, সবসময় ঘরোয়া চিকিৎসায় দাঁতের ব্যাথা ভালো হয়না। একটা পর্যায়ে গেলে দাঁতের ব্যথা সারাতে চিকিৎসার প্রয়োজন হবে। প্যারাসিটামল ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আপনাকে কিছুটা হেল্প করতে পারে।
দাঁতের ব্যথার সাথে নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবশ্যই ডেন্টিস্টের কাছে যাবেন-
- জ্বর
- শ্বাস নিতে বা গিলতে সমস্যা
- সাধারণ ব্যথা যা এক বা দুই দিনের বেশি স্থায়ী হয়
- মাড়ি বা চোয়াল ফোলা
- কামড় দিলে ব্যথা অনুভব
- অস্বাভাবিকভাবে লাল মাড়ি
- মাড়ি থেকে পুঁজ বের হওয়া
কথায়ই আছে, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না। দাঁতের ব্যাথা যে কত বড় স্বাস্থ্য সমস্যা তা কেবল যার হয় সেই বুঝতে পারেন। অবহেলা না করে দাঁতের ব্যথার মূল কারণ খুঁজে বের করার জন্য একজন ডেন্টিস্টের পরামর্শ নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। তবে তীব্র ব্যাথা বা গুরুতর সমস্যা না হলে দাঁতের ব্যাথা সারাতে উপরে উল্লিখিত ঘরোয়া প্রতিকারগুলো ব্যবহারে ভালো ফল পাবেন।
Reference
Frank, C. (2022, July 11). 11 Home and Natural Remedies for Toothache Pain. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/dental-and-oral-health/home-remedies-for-toothache
CDC. (2022, April 6). Oral Health Conditions. Retrieved from CDC: https://www.cdc.gov/oralhealth/conditions/index.html
Last Updated on April 12, 2023
Leave A Comment