একসময় পশুখাদ্য হিসেবে এর ব্যপক ব্যবহার থাকলেও, মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও পুষ্টিগুণে অনন্য এই ওটস। পুষ্টিকর খাবারের তালিকায় ওটস বেশ উপরের দিকে থাকার মূল কারণ হচ্ছে, এতে থাকা প্রচুর পরিমাণের ফাইবার। আরও আছে কোলেস্টেরল বিরোধী বেটা-গ্লুকান, ম্যাংগানিজ, ফসফরাস, কপার, জিঙ্ক, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি১, সেলেনিয়াম ইত্যাদির মতো মিনারেল। 

ওটস কি? 

ওটস হচ্ছে ধান-গমেরই পরিবারভুক্ত এক প্রকার শস্য। যার চাষ হয়ে আসছে আজকে ৪ হাজার এর বেশি সময় ধরে। ঠান্ডা আবহাওয়ায় এর ফলন সবচেয়ে ভালো হয়।

এক কাপ ওটসে রয়েছে,

  • ৩০৭ ক্যালরি
  • ৮.৭ গ্রাম পানি
  • ১০.৭ গ্রাম প্রোটিন
  • ৫৪.৮ গ্রাম কার্ব
  • ০.৮ গ্রাম সুগার
  • ৮.১ গ্রাম ফাইবার
  • ৫.৩ গ্রাম ফ্যাট

(Bjarnadottir, 2019)

ওটস এর উপকারিতাঃ

পশ্চিমা দেশগুলোয় ওটসের ব্যপক পরিচিতি বহুকাল ধরেই। স্বাস্থ্য রক্ষায় এর অজস্র গুনাগুনের কারনে পশ্চিমা দেশগুলোর গন্ডি ছাড়িয়ে বাংলাদেশ এবং আশেপাশের এশিয়ান অঞ্চলগুলোতেও বাড়ছে ওটস খাওয়ার হার। চলুন জেনে নেই ওটসের তেমনই কিছু উপকারিতা। 

১. কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রনঃ

ওটসে থাকা প্রচুর ফাইবার শরীরের ক্ষতিকর লিপিড বা চর্বির পরিমানকে কমাতে সাহায্য করে। খারাপ কোলেস্টেরলকে নষ্ট করার সাথে শরীরে থাকা ভালো কোলেস্টেরলকে সুরক্ষা দেয়। ওটসে উচ্চ মাত্রায় থাকা বেটা-গ্লুকান খাবারের সাথে প্রবেশ করা কোলেস্টেরল ও চর্বিকে শরীরে বসতে দেয় না। 

২. টাইপ-২ ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনঃ

ওটসে প্রচুর ফাইবার থাকায় তা একবার খেলে হজম হয় ধীরে ধীরে। যার ফলে রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রনে থাকে। এতে উপস্থিত বেটা-গ্লুকান রক্তে গ্লুকোজ বা সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি ইনসুলিনের কার্যক্ষমতাও বাড়ায়। এভাবেই একজন মানুষের শরীরে টাইপ-২ ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে ভূমিকা রাখতে পারে ওটস। 

৩. ওজন নিয়ন্ত্রনঃ

যারা শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে কিংবা বাড়তে থাকা ওজন নিয়ন্ত্রন করতে চান, তারা সকাল ও রাতের খাবার হিসেবে রাখতে পারেন ওটসকে। ফাইবারে ভরপুর একবাটি ওটস খেলে এটি হজম হতে সময় নেয় অন্যান্য খাবার থেকে বেশি। অর্থাৎ, বেশ লম্বা সময় ধরে পেট ভরা থাকে এবং বারবার ক্ষুধা লাগে না। প্রোটিন ও শর্করা থাকায়, শরীরে শক্তিও জোগাতে থাকে একই সাথে। 

৪. হৃদরোগ নিয়ন্ত্রনঃ

যেহেতু ওটস শরীরের খারাপ কোলেস্টেরলকে ব্যপকভাবে কমাতে ভূমিকা রাখে। সেই সুত্রেই ওটস হৃদরোগের আশঙ্কাও কমায়। কারণ শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল হৃদরোগের ঝুঁকি ব্যপকভাবে বাড়িয়ে দেয়। ওটসের এন্টি-অক্সিডেন্ট এবং এন্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে, যা হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী। এছাড়াও এতে থাকা বেটা-গ্লুকান ও অন্যান্য ভিটামিন, মিনারেলও হার্ট বা হৃদযন্ত্রকে সুরক্ষা দেয়। 

৫. ত্বকের সুরক্ষাঃ 

অনেকেই ত্বকের যত্নে বাহ্যিকভাবে ওটস ত্বকে ব্যবহার করেন। তবে জেনে রাখা ভালো যে, ওটস বা ওটস দিয়ে প্রস্তুত কোন খাবার মুখে খাওয়াও ত্বকের জন্য উপকারী। কারণ এমিনো এসিড, ফ্যাটি এসিড, এন্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর ওটস খাওয়ার পর সেটা ভেতর থেকে একজন মানুষের ত্বককে সুস্থ ও সজীব রাখতে সাহায্য করে। 

৬. ক্যান্সার প্রতিরোধঃ 

মানবদেহে ক্যান্সার হওয়ার জন্য অন্যতম দায়ী হচ্ছে ক্ষতিকর ফ্রি র‍্যাডিকেল। ওটসে থাকা এন্টি-অক্সিডেন্ড মানুষের শরীরের এই ক্ষতিকর ফ্রি-র‍্যাডিকেলের সাথে লড়াই করে। যার ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। বিশেষ করে কোলন ক্যান্সার প্রতিরধে ওটস খাওয়া খুবই উপকারী। কারণ এতে উপস্থিত প্রচুর ফাইবার হজম প্রক্রিয়া সহজ করে, কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে এবং সব মিলিয়ে কোলনকে সুস্থ রাখে। 

এমনকি অনেক ক্যান্সার রোগীকেও চিকিৎসা চলাকালীন ওটস খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এর কারণ হচ্ছে, অন্যান্য শস্যের তুলনায় ওটসের পুষ্টিগুণের আধিক্য। 

ওজন কমাতে ওটস খাওয়ার নিয়ম

ওটস বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া যেতে পারে। আপনি এটিকে কাঁচা, রান্না করা বা প্রসেস করা ওটস খেতে পারেন। কাঁচা ওটস খাওয়ার সময়, আপনাকে এটিকে ধুয়ে ফেলতে হবে এবং তারপরে লবণ, মশলা বা অন্যান্য উপাদান দিয়ে মিশিয়ে খেতে হবে। রান্না করা ওটস খেতে হলে, আপনাকে এটিকে দুধ বা পানি দিয়ে রান্না করতে হবে। প্রসেস বা প্যাকেটজাত ওটসের ক্ষেত্রে, আপনি এটিকে শুধুমাত্র গরম করে খেতে পারবেন।

চলুন দেখে নেই ওটস রান্নার কয়েকটি রেসিপি –

১. দুধ-ওটসঃ 

সকালের নাস্তায় দুধ-ওটস খেলে শরীরে শক্তি যোগানোর পাশাপাশি লম্বা সময় ধরে পেটও থাকে ভরা। যা যা লাগছে-

উপকরনঃ

  • এক কাপ দুধ
  • এক কাপ ওটস
  • এক চিমটি লবন
  • দারচিনি গুড়া (ইচ্ছে অনুসারে)
  • এক টেবিল চামচ মধু

পদ্ধতিঃ 

একটি ফ্রাইপ্যানে দুধ এবং ওটস একসাথে নিয়ে অল্প আঁচে জ্বাল দিতে হবে। কিছুক্ষন পর লবন এবং দারচিনি গুড়া তাতে মিশিয়ে আবার কিছুক্ষন জ্বাল দিতে হবে। মিশ্রণটি কিছুটা ঘন হয়ে আসলে চুলা থেকে সরিয়ে ঠান্ডা হবার জন্য রাখতে হবে। ঠান্ডা হয়ে আসার পর মধু মিশিয়ে নিলেই এটি খাওয়ার জন্য প্রস্তুত। 

২. দই-ওটসঃ 

ওটস দিয়ে তৈরি ওজন কমাতে কার্যকরী এই খাবারটি মূলত বানানোর পর সারারাত রেখে সকালে খেতে হয়। এটি তৈরির পদ্ধতি,

উপকরনঃ

  • এক কাপ দই
  • এক টেবিল চামচ মধু
  • এক কাপ ওটস
  • এক চিমটি লবন
  • দারচিনি গুড়া (ইচ্ছে অনুসারে)
  • পছন্দ অনুযায়ী বাদাম ও ড্রাই ফ্রুটস 
  • ভ্যানিলা ক্রিম বা ফ্লেভার 

পদ্ধতিঃ

বাদাম ও ড্রাই ফ্রুটস বাদে বাকি সব উপাদান একসাথে মিশিয়ে নরম মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। তারপর বাদাম ও ড্রাই ফ্রুটস মিশিয়ে একটি বাটি বা জারে মখ বন্ধ করে মিশ্রণটি ঢেকে রেখে দিতে হবে সারারাত। তারপর সকাল সকাল নাস্তা হিসেবে খেয়ে নিতে পারেন মজাদার এই খাবারটি।

৩. দুধ-কলা-ওটসঃ

এই রেসিপিটি তৈরিতে সময় খুব কম লাগলেও, দুধ ও ওটসের সাথে কলা থাকার কারনে এটি শরীরে শক্তি যোগাতে পারে লম্বা সময় ধরে। যেভাবে তৈরি করবেন খাবারটি,

উপকরনঃ

  • এক কাপ দুধ
  • এক টেবিল চামচ মধু
  • এক কাপ ওটস
  • এক চিমটি লবন
  • একটি কলা টুকরো করে কাঁটা 
  • এক টেবিল চামচ পিনাট বাটার

পদ্ধতিঃ

একটি ফ্রাইপ্যানে দুধ এবং ওটস একসাথে নিয়ে অল্প আঁচে জ্বাল দিতে হবে। কিছুক্ষন পর লবন দিয়ে দেয়ার পর চুলার আঁচ একদমই কমিয়ে দিতে হবে কিংবা বন্ধ করে দিতে হবে। মিশ্রণটি কিছুটা ঠান্ডা ও ঘন হয়ে গেলে তাতে কলা, মধু ও পিনাট বাটার মিশালেই, এটি খাওয়ার জন্য প্রস্তুত। 

৪. ওটস-চা-স্মুদিঃ 

একদমই ভিন্নধর্মী এই রেসিপিটি তৈরি করে আপনি পানীয়র মতো পান করতে পারবেন। তবে পেট ভরাবে ও শক্তি জোগাবে যেকোনো ভারী খাবারের মতোই। যেভাবে বানাবেন এই পানীয়টি,

উপকরনঃ

  • এক কাপ চা-এর লিকার (নিজের পছন্দের যে কোন চা)
  • ছোট টুকরো করে কাঁটা অর্ধেকটা কলা
  • আধা কাপ ওটস (নিজের পছন্দের ঘনত্ব অনুযায়ী কম বেশি হতে পারে এর পরিমাণ)

পদ্ধতিঃ

সব উপকরণ একসাথে মিশিয়ে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করতে হবে যতক্ষন না সব মিশ্রণ মিলে স্মুথ পানীয়তে পরিণত হয়। 

আশা করি ওটস বিষয়ক তথ্যগুলি আপনাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরো স্বাস্থ্যকর করে তুলতে সাহায্য করবে। আর যারা ওজন নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত হয়ে আছেন, তারা ওটস দিয়ে তৈরি নতুন রেসিপিগুলো বানিয়ে খেতে পারেন অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর খাবারের বদলে। 

বাচ্চাদের জন্য ওটস এর উপকারিতা

৬ মাসের পর থেকে শিশুদের মায়ের দুধ ছাড়া অন্য খাবার দেয়া শুরু করা হয়। অনেকসময়ই দেখা যায় সেসব খাবারে শিশুদের হজমে ও মলত্যাগে সমস্যা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে ফাইবারযুক্ত ওটস হতে পারে শিশুদের পেটের জন্য খুবই উপকারী। 

সতর্কতা

তবে ছোট শিশুদের ওটস খাওয়ানোর আগে কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে,

  •     শিশুর বয়স অবশ্যই ৬ মাসের উর্ধ্বে হতে হবে
  •     পর্যাপ্ত পানি বা শিশুর খাওয়ার উপযুক্ত দুধ মেশাতে হবে
  •     ওটস আস্ত রাখা যাবে না, পেস্ট বা পিউরি হতে হবে
  •     অন্তত ২০ মিনিট ধরে ভালো করে সেদ্ধ করতে হবে
  •     প্রথমবার খুব সামান্য খাইয়ে নিশ্চিত হতে হবে, শিশুর ওটসে এলার্জি আছে কি না
  •     অনেক বেশি খাওয়ানো যাবে না, অন্যান্য খাবারও খাওয়াতে হবে
  •     কেমন পরিমাণ খাওয়াবেন তা নিয়ে সন্দেহ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে

ওটস এর অপকারিতা

প্রচুর ইতিবাচক দিক থাকলেই যে কোন খাবার আপনার ক্ষতি করবে না, তা কিন্তু নয়। স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত যে কোন কিছুই হতে পারে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এরকমই কয়টি ক্ষতিকর দিন জেনে রাখুন ওটসের,

  • নতুন ওটস খাওয়া শুরু করলে এটি গ্যাসের সমস্যার কারণ হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথম দিকে পরিমাণে অল্প করে খাওয়া শুরু করতে হবে।
  • ওটসের পানশে স্বাদ পছন্দ না হওয়ায়, অনেকেই এর সাথে চিনি, চকোলেটের মতো উচ্চ ক্যালরিসম্পন্ন জিনিস মেশান। এতে ওজন কমানোর বদলে উলটো ওজন বাড়ার কারণ হয় ওটস।
  • অন্যান্য খাবার একদমই বাদ দিয়ে শুধুই ওটসের উপর নির্ভরশীল হয়ে গেলে, শরীরের উপকারী মাংসপেশিগুলো দুর্বল ও শুকিয়ে যেতে পারে। হতে পারে পুষ্টির অভাবও।
  • ওটসের ফাইবার হজম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করলেও, অতিরিক্ত ওটস খাওয়া এই হজম প্রক্রিয়ার জন্যই হতে পারে ক্ষতিকর।
  • গর্ভবতী নারীদের ওটস খাওয়া উচিত নয়। শরীরে দুর্বলতার আসার পাশাপাশি কমে যেতে পারে বুকের দুধও।
  • বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে ওনেক বেশি ওজনের সমস্যা না থাকলে নিয়মিত ওটস না খাওয়াই ভালো। এতে তাদের বাড়ন্ত শরীরে দেখা দিতে পারে পুষ্টির অভাব ও দুর্বলতা। 

আশা করি ওটস বিষয়ক তথ্যগুলি আপনাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরো স্বাস্থ্যকর করে তুলতে সাহায্য করবে। আর যারা ওজন নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত হয়ে আছেন, তারা ওটস দিয়ে তৈরি নতুন রেসিপিগুলো বানিয়ে খেতে পারেন অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর খাবারের বদলে।

 

Last Updated on December 18, 2023