বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মানুষের ক্ষেত্রে দূষিত খাবার খাওয়ার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে যার মধ্যে প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করেন। খাবার দূষিত হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। এছাড়াও ভাইরাস, প্যারাসাইট ও ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানের প্রভাবেও খাবার দূষিত হয়ে থাকে। (WHO, 2022)
খাদ্যে ব্যাকটেরিয়া সংক্রামণ কিভাবে হয়, কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং খাবার দূষিত হওয়া (ব্যাকটেরিয়ার সংক্রামণ) প্রতিরোধে করণীয় কি সেই সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
ব্যাকটেরিয়া সংক্রামণ কি?
খাবারের সংস্পর্শে এসে ব্যাকটেরিয়া সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকলে খাবার দূষিত হয়ে যায় যাকে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রামণ (Bacterial contamination) বলা হয়। ব্যাকটেরিয়া সংক্রামিত খাবার খেলে মানুষ অসুস্থ পড়ে। এক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব ৩টি উপায়ে হয়ে থাকে। যথাঃ (Davidson, 2021)
১। ব্যাকটেরিয়া সংখ্যায় বৃদ্ধি ঘটায় এবং খাবারে বিষাক্ত উপাদান (Toxins) নিঃসরণ করে। অতঃপর সেই খাবার খাওয়ার ফলে বিষাক্ত উপাদানের প্রভাবে পেটে সমস্যা সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে যেসব ব্যাকটেরিয়া দায়ী থাকে তা হলোঃ
- Clostridium perfringens
- Staphylococcus aureus
- Clostridium botulinum
২। ব্যাকটেরিয়া সংক্রামিত খাবার খাওয়ার ফলে ব্যাকটেরিয়া পেটে প্রবেশ করে সমস্যা সৃষ্টি করে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বিষাক্ত উপাদান নয়, বরং ব্যাকটেরিয়া নিজেই সমস্যা সৃষ্টি করে। এই জাতীয় ব্যাকটেরিয়াগুলো হলোঃ
- Salmonella
- Listeria monocytogenes
- Shigella
৩। ব্যাকটেরিয়া সংক্রামিত খাবার খাওয়ার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া পেটে প্রবেশ করার পর বিষাক্ত উপাদান নিঃসরণ করে এবং সেই বিষাক্ত উপাদানের প্রভাবে পেটে সমস্যা হয়। এই জাতীয় ব্যাকটেরিয়াগুলো হলোঃ
- Escherichia coli (E. coli)
- Campylobacter jejuni
- Vibrio
ব্যাকটেরিয়া সংক্রামণের লক্ষণ
ব্যাকটেরিয়া সংক্রামিত খাবার খাওয়ার ফলে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ
- বমি বমি ভাব
- পেটে ব্যথা
- ক্ষুধা কমে যাওয়া
- ডায়রিয়া
- মাথাব্যথা
সাধারণত ব্যাকটেরিয়া সংক্রামিত খাবার খাওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘন্টার মধ্যেই সমস্যা (উল্লেখিত লক্ষণ সমূহ) দেখা যায়। আবার ব্যাকটেরিয়ার ধরনভেদে লক্ষণ প্রকাশের ক্ষেত্রে (সর্বোচ্চ ১ সপ্তাহ) দেরি হতে পারে।
যেসব খাবার সহজেই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত হয়
যেকোনো ধরনের খাবার ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত হতে পারে। তবে প্রচুর পরিমাণ পানি, স্টার্চ (Starch) ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া সংক্রামণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে। কারণ এই উপাদানগুলো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। ব্যাকটেরিয়া সংক্রামণের ঝুঁকিপূর্ণ খাবারগুলো হলোঃ
- কাঁটা ফলমূল ও শাকসবজি
- ভাত, পাস্তা ও আলুর রেসিপি
- মাছ, মাংস ও ডিম
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
- সালাদ, স্যুপ, সস ইত্যাদি
খাদ্যে কিভাবে ব্যাকটেরিয়া সংক্রামিত হয়?
খাদ্য তৈরি করা থেকে শুরু করে পরিবেশন যেকোনো পর্যায়ে ব্যাকটেরিয়া সংক্রামিত হতে পারে। কারণ প্রকৃতিতে কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। ব্যাকটেরিয়া সংক্রামণ হওয়ার সম্ভাব্য উপায়গুলো হলোঃ
- খাবার তৈরির সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে অনীহা
- খাবার এমন পাত্রে সংরক্ষণ করা যা ব্যাকটেরিয়া মুক্ত নয়
- খাবার পরিবেশনের সময় হাত ও বাসনপত্র জীবাণুমুক্ত না থাকা
খাবার ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত হওয়ার প্রধান উপায় হলো একটি দূষিত খাবার থেকে অন্যান্য খাবারে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়া। যেমনঃ কাঁচা মাছ ও মাংসে স্বভাবতই ব্যাকটেরিয়া থাকে। বাজার করার সময় মাছ, মাংস, ফলমূল ও শাকসবজি একই ব্যাগে রাখলে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়। আবার মাছ ও মাংস কাটার পর ছুরি ও চপিং বোর্ড ভালোভাবে না ধুয়ে সেটা দিয়ে ফলমূল ও শাকসবজি কাঁটা হলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রামণ হতে পারে।
খাবার খোলা অবস্থায় রাখলে তাতে মাছি বসার সুযোগ পায়। মাছি বিভিন্ন রোগের ব্যাকটেরিয়া বহন করে। তাই মাছির মাধ্যমে খাবারে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রামণ হতে পারে।
খাবারে ব্যাকটেরিয়া সংক্রামণ হওয়ার অনুকূল তাপমাত্রা হলো ৪ থেকে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা ফারেনহাইট স্কেল অনুযায়ী ৪০ থেকে ১৪০ ডিগ্রি। এই তাপমাত্রায় খাবার রেখে দিলে তাতে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রামণ হতে পারে। কারণ বায়ুতে প্রচুর ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া বিদ্যমান রয়েছে যা খাবারের সংস্পর্শে এসে খাবার দূষিত করে ফেলতে পারে।
ব্যাকটেরিয়া সংক্রামণ কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে?
ব্যাকটেরিয়া খাবারের সংস্পর্শে আসার পর খুব দ্রুত বংশবিস্তার বা বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। ৪ থেকে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় খাবার ২০ মিনিট রাখলেই ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির হার বাড়তে থাকে। খাবার ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শের পরবর্তী ২ ঘন্টার মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা এতোটাই বেড়ে যায় যে সেই খাবার ফেলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির হার ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে কমে যায়। তাই খাবার ফ্রিজে রাখলে ভালো থাকে। আর উচ্চ তাপমাত্রা (৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) হলো ব্যাকটেরিয়ার জন্য প্রতিকূল অবস্থা। অর্থাৎ তাপে ব্যাকটেরিয়া মারা যেতে থাকে।
ব্যাকটেরিয়ার সংক্রামণ কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
প্রকৃতিতে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া বিদ্যমান যা বায়ু, হাত, ব্যাগ, কাঁচা মাছ ও মাংস থেকে বিভিন্নভাবে খাবারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ব্যাকটেরিয়ার ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করা কষ্টসাধ্য কাজ তবে কতিপয় নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কমানো যায়। যেমনঃ
- কাঁচা মাছ ও মাংস থেকে ফলমূল ও শাকসবজি আলাদা রাখতে হবে।
- ছুরি, চপিং বোর্ড, বাসনপত্র ও হাত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- খাবার খোলা রাখা যাবে না। ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে যেন তাতে মাছি বসতে না পারে।
- প্যাকেটজাত খাবার কেনার সময় মেয়াদ দেখে কিনতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার কেনা যাবে না।
নিরাপদে খাবার প্রস্তুত করার জন্য টিপস
খাবারে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রামণ ঠেকানো বা নিরাপদে খাবার প্রস্তুত করার জন্য নিচে উল্লেখিত নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে।
- ডিম ধুয়ে ফ্রিজে রাখতে হবে।
- মাছ ও মাংস ফ্রিজে রাখার জন্য কেটে ও ধুয়ে রাখতে হবে।
- মাছ ও মাংস রান্না করার সময় ভালোভাবে সিদ্ধ করতে হবে।
- খাবার রান্না ও পরিবেশনের আগে বাসনপত্র ও হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
- শাকসবজি কাটার জন্য ছুরি ও চপিং বোর্ড ধুয়ে নিতে হবে।
- ফলমূল না ধুয়ে খাওয়া যাবে না।
References
Davidson, K. (2021, September 2). How Quickly Can Bacterial Contamination Occur? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/how-quickly-can-bacterial-contamination-occur
WHO. (2022, May 19). Food safety. Retrieved from WHO: https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/food-safety
Last Updated on November 20, 2023
Leave A Comment