হরমোন শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে যার মধ্যে অন্যতম হলো ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ, হজম, বিপাক প্রক্রিয়া ইত্যাদি। শরীরে হরমোন নিঃসরণের মাত্রা কম বা বেশি হলে ওজন কমে যায় বা বেড়ে যায়। তবে শরীরের সব হরমোন ওজনের সাথে সম্পর্কিত নয়। 

হরমোন কিভাবে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে, কোন কোন হরমোন শরীরের ওজনের সাথে সম্পর্কিত, হরমোন নিঃসরণ কি কি বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয় ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।  

হরমোন শরীরের ওজন প্রভাবিত করে 

পিটুইটারি, থাইরয়েড, প্যানক্রিয়াস ও এডরেনাল গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন সহ ক্ষুধা ও পেট ভরার অনুভূতির হরমোন (Hunger & Satiety hormones) শরীরের ওজনের সাথে সম্পর্কিত। (Kubala, 2021)

পিটুইটারি ও থাইরয়েড 

endocrinologist

পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের অবস্থান মস্তিষ্কে যা থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। আর থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হওয়া হরমোন বিপাক প্রক্রিয়ায় (Metabolism) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাইরয়েড গ্রন্থির অবস্থান গলায় যা দেখতে অনেকটা প্রজাতির মতো দেখা যায়। 

থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি মাত্রায় হরমোন নিঃসরণ হলে তাকে Hyperthyroidism বলা যায়।‌ এমতাবস্থায় মেটাবলিক রেট বা বিপাক প্রক্রিয়ার গতি বেড়ে যায় এবং প্রচুর ক্যালরি খরচ হতে থাকে। তাই Hyperthyroidism এর ক্ষেত্রে সাধারণত শরীরের ওজন কমে যায়। 

আবার থাইরয়েডের কার্যক্রম সঠিকভাবে না‌ হলে অর্থাৎ কম মাত্রায় হরমোন নিঃসরণ হলে তাকে Hypothyroidism বলা হয় যার ফলে বিপাক প্রক্রিয়ার গতি কমে যায় এবং শরীরের ওজন বাড়তে থাকে। 

প্যানক্রিয়াস 

পেটের ভেতর পাতার মতো দেখতে একটি অঙ্গ রয়েছে যার নাম হলো প্যানক্রিয়াস। প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন নামক হরমোন নিঃসরণ হয় যা শর্করা জাতীয় খাবার তথা গ্লুকোজ কোষের ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করে। বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গ্লুকোজ ভেঙে ক্যালরি বা এনার্জি উৎপন্ন হয়। 

ইনসুলিনের প্রতি কোষের সংবেদনশীলতা কমে গেলে তাকে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বলা হয়। যার ফলে শর্করা জাতীয় খাবার (ভাত বা রুটি) খাওয়া হলে গ্লুকোজ কোষে ঢুকতে পারে না। এমতাবস্থায় গ্লুকোজ ফ্যাট হিসেবে শরীরে জমা হতে থাকে এবং শরীরের ওজন বেড়ে যেতে দেখা যায়।  

পরিশ্রমী মানুষের ক্ষেত্রে ক্যালরি চাহিদা অনেক বেশি থাকে। আর তাছাড়া পরিশ্রম করার ফলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হয় না তথা কোষ ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীল থাকে এবং গ্লুকোজ গ্রহণ করে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি সরবরাহ করে। তাই পরিশ্রম করেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে দেখা যায় না। 

এডরেনাল গ্ল্যান্ড 

adrenal gland

দুই কিডনির উপর দুইটি গ্ল্যান্ড রয়েছে যার নাম এডরেনাল গ্ল্যান্ড। এই গ্ল্যান্ড থেকে কর্টিসল হরমোন নিঃসরণ হয় যা শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে। অতিরিক্ত মানসিক চাপের প্রভাবে এবং Cushing syndrome নামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এডরেনাল গ্ল্যান্ড থেকে অতিরিক্ত মাত্রায় কর্টিসল হরমোন নিঃসরণ হয়। 

অতিরিক্ত কর্টিসল হরমোনের প্রভাবে ক্ষুধা বেড়ে যায় এবং শরীরে ফ্যাট জমতে থাকে। তাই যারা দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে সময় পার করছেন বা Cushing syndrome রোগে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে দেখা যায়।   

ক্ষুধার সাথে সম্পর্কিত হরমোন 

ক্ষুধার অনুভূতি সৃষ্টির সাথে কিছু হরমোন সম্পর্কিত যাদেরকে Hunger hormones বলা হয়। অর্থাৎ এই হরমোনগুলোর মাত্রা বেড়ে গেলে ক্ষুধার অনুভূতি জাগে আবার খাবার খাওয়ার ফলে এর মাত্রা কমে যায়। ক্ষুধার সাথে সম্পর্কিত হরমোনগুলোর নাম হলোঃ  

  • Ghrelin 
  • Motilin 
  • Neuropeptide Y (NPY) 
  • Agouti-related protein (AgRp) 

সাধারণত যাদের শরীরের ওজন বেশি, কম পরিশ্রম করেন বা রাতে ভালো ঘুম হয় না তাদের ক্ষেত্রে এই হরমোন নিঃসরণ বেড়ে যায়। (Landes, 2023) 

পেট ভরা‌ (Satiety) অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত হরমোন 

খাওয়ার পরে কিছু হরমোন নিঃসরণ হয় যা পেট ভরে গেছে এই অনুভূতির সৃষ্টি করে। এই জাতীয় হরমোনগুলোকে Satiety (fullness) hormones বলা হয়। যেমনঃ 

  • Cholecystokinin (CCK)
  • Glucagon-like peptide-1 
  • Pancreatic peptide YY
  • Leptin
  • Insulin
  • Obestatin 

খাবার খাওয়ার পরে এই জাতীয় হরমোন নিঃসরণ হলেও শরীর যদি হরমোনের প্রতি সংবেদনশীল না থাকে অর্থাৎ রেজিস্ট্যান্স হয় সেক্ষেত্রে বেশি খাবার খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।  

হরমোন চিকিৎসা, বয়স ও ওজন বৃদ্ধি দ্বারা কি পরিবর্তিত হতে পারে?

শরীরে হরমোন নিঃসরণের মাত্রা বয়স, বিভিন্ন রোগ ও ওজনের সাথে সম্পর্কিত। 

ওজন 

যাদের শরীরের ওজন বেশি তাদের ক্ষেত্রে ক্ষুধার সাথে সম্পর্কিত হরমোন সহ অন্যান্য হরমোন নিঃসরণের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা দেখা যায় যার ফলে বেশি খাবার খাওয়া হয়‌ এবং শরীরের ওজন আরো বেড়ে যায়। 

বয়স

বয়স বেড়ে যাওয়ার সাথে শরীরে কিছু হরমোনের পরিবর্তন হয় যার ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে। 

পুরুষদের ক্ষেত্রে ৩০ বছর বয়সের পর থেকে টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণ কমে যেতে থাকে। টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ কমে গেলে শরীরে ফ্যাট জমার প্রবণতা বেড়ে যায় তথা শরীরের ওজন বাড়তে থাকে। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনোপজের সময় হরমোনের পরিবর্তনের ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।  

রোগ 

বিভিন্ন রোগের প্রভাবে শরীরের গ্রন্থি থেকে স্বাভাবিক হরমোন নিঃসরণ ব্যাহত হয় যা ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেসব রোগের কারণে হরমোনের পরিবর্তন হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ 

  • পলিসিস্টিক ওভারী সিনড্রোম 
  • হাইপোথাইরয়েডিজম 
  • Cushing syndrome 
  • ডায়াবেটিস (Diabetes)
  • Hyperparathyroidism
  • Addison disease

অন্যান্য কারণ যা হরমোনকে প্রভাবিত করে 

  • শরীরের কার্যক্রম ও হরমোন নিঃসরণ স্বাভাবিক রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম প্রয়োজন। প্রতিদিন রাতে ৭ – ৯ ঘন্টা ঘুমাতে হবে। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে শরীরে হরমোন নিঃসরণ বিঘ্নিত হয়। 
  • কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম শরীরে হরমোন নিঃসরণ ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।   
  • মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে হরমোন নিঃসরণের যোগসূত্র রয়েছে। শরীরের হরমোনের মাত্রা ভালো রাখতে মানসিক সুস্থতা জরুরী।  

আপনার ক্ষেত্রে কোন ধরনের হরমোনের প্রভাবে শরীরের ওজন বেড়ে যাচ্ছে তা জানার জন্য একজন হরমোন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সমস্যা চিহ্নিত করতে সক্ষম হবেন। যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

References

Kubala, J. (2021, September 15). How Hormones Influence Your Weight: All You Need to Know. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/how-hormones-influence-your-weight-all-you-need-to-know

Landes, E. (2023, 2 15). 9 Hormones That Affect Your Weight — and How to Improve Them. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/9-fixes-for-weight-hormones

Last Updated on December 21, 2023