যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ (NIH of US) এর তথ্য অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাতজ্বরের (Rheumatic fever) প্রকোপ উন্নত দেশের (যেমন: আমেরিকা) তুলনায় অনেক বেশি। সেই সাথে আরেকটি প্রধান সমস্যা হলো বাতজ্বর জনিত হৃদরোগ (Rheumatic heart disease) যার দরুন প্রতি বছর সারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। (Newman, 2018) 

পাঠক এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে বাতজ্বর মোটেও সাধারণ কোনো রোগ নয় যার প্রভাব শুধুমাত্র জ্বর ও ব্যাথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বরং তা সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক হয় হার্টের সমস্যা সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে। আর তাই বাতজ্বর বিষয়ক জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই অনুচ্ছেদে বাতজ্বরের কারণ, লক্ষণ, জটিলতা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সহ বাতজ্বর প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

 

বাতজ্বর কি? (What is Rheumatic fever)

বাতজ্বর হলো একটি ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ যার সূত্রপাত হয়ে থাকে স্ট্রেপ্টোকক্কাস (Streptococcus) নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে গলায় ইনফেকশন (Strep throat) বা স্কারলেট ফিভার (Scarlet fever) এর মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ এই‌ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে গলায় ইনফেকশন বা জ্বর হওয়ার পর যদি তার যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তখন বাতজ্বরের সূচনা হয়ে থাকে। তবে স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ মানেই কিন্তু বাতজ্বর নয়। বরং এর সাথে আরো একটি কারণ জড়িত রয়েছে। (Newman, 2018)

উল্লেখ্য বাতজ্বর কোনো ছোঁয়াচে (Contagious) প্রকৃতির রোগ নয়। অর্থাৎ রোগীর সংস্পর্শে গেলে এই রোগে‌র সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে হাঁচি বা কাশির সাথে নির্গত বিন্দু (Droplets) এর মাধ্যমে এই‌ রোগের ব্যাকটেরিয়া একজনের দেহ থেকে অন্যজনের দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে যা প্রথমত গলায় ইনফেকশন বা স্কারলেট ফিভারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে তা শুরুতেই বাতজ্বর সংক্রমণের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় না।

বাতজ্বর কেন হয়?

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী বাতজ্বরের প্রকৃত কারণ শুধুমাত্র স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া নয় বরং এর সাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার (Immune system) বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে। স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের পর গলায় ইনফেকশন বা স্কারলেট ফিভার যাই হোক না কেনো তার জন্য যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না‌ হলে তখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একটি বিশেষ প্রকৃতির এন্টিবডি তৈরি করে থাকে যা পরবর্তীতে বাতজ্বরের সূচনা করে।  অর্থাৎ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজে‌ থেকে গলার ইনফেকশন বা স্কারলেট ফিভার সারানোর জন্য এন্টিবডি তৈরি করে থাকে কিন্তু সেই বিশেষ এন্টিবডি পরবর্তীতে বাতজ্বরের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাতজ্বরের প্রাদুর্ভাব বেশি হওয়ার একটি প্রধান কারণ হলো ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের পর যথাযথ এন্টি-বায়োটিক ওষুধ গ্রহণ না করা। অপরদিকে উন্নত বিশ্বে স্ট্রেপ্টোকক্কাস ইনফেকশন দেখা দিলে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা তথা এন্টি-বায়োটিক সেবনের মাধ্যমে পরবর্তীতে বাতজ্বর হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে যায়।

বাতজ্বর এর রিস্ক ফ্যাক্টর গুলো কি কি?

বাতজ্বরের রিস্ক ফ্যাক্টর (Risk factors) গুলো নিচে তুলে ধরা হলো: 

  • সাধারণত ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সের ছেলে মেয়েদের ক্ষেত্রে বাতজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে।‌ তবে বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রেও বাতজ্বর হতে পারে কিন্তু তা খুবই বিরল প্রকৃতির
  • বংশগত ভাবে (Family history) এই রোগের সংক্রমণের ইতিহাস থাকলে অথবা কিছু বিশেষ প্রকৃতির জিন (Gene) প্রাপ্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অধিক সম্ভাবনা রয়েছে
  • গলায় ইনফেকশন বা স্কারলেট ফিভারে আক্রান্ত হওয়ার পর এন্টি-বায়োটিক ওষুধ সেবন না‌ করা অথবা এন্টি-বায়োটিক ওষুধের পুরো কোর্স সম্পন্ন না করা
  • এছাড়াও অধিক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে অনীহার ফলে এই রোগের সংক্রমণ হয়ে থাকে

বাতজ্বরের রিস্ক ফ্যাক্টর

বাতজ্বর এর লক্ষণ কি কি?

যেহেতু বাতজ্বরের সাথে জ্বর (Scarlet fever) ও গলায় ইনফেকশনের (Strep throat) বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে আর তাই এই ব্যাপারে যথাযথ ভাবে জেনে নেওয়া জরুরি। বিশেষত ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ফলে সর্বপ্রথম দেখা দেয় গলার সমস্যা বা স্কারলেট ফিভার আর তখন এই‌ রোগের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। গলায় ইনফেকশন হলে সে ক্ষেত্রে যে সমস্ত লক্ষণাবলী দেখা যেতে পারে তা হলো:

  • গলা ব্যথা (Sore throat) এবং খাবার গিলতে কষ্ট
  • মাথাব্যথা (Headache) ও বমি বমি ভাব অথবা বমি
  • লিম্ফ নোড (Lymph Nodes) ফুলে যাওয়া ও ব্যথা বোধ
  • টনসিল ফুলে যাওয়া (tonsillitis)
  • শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া
  • পেটে ব্যথা ইত্যাদি

সাধারণত স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পরে বাতজ্বরের লক্ষণাবলী প্রকাশ পায়। ব্যক্তি বিশেষে লক্ষণ সমূহের যেমন তারতম্য হতে পারে তেমনি ভাবে সকল মানুষের বেলাতেই সবগুলো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। বরং ২ বা ৩ টি ‌লক্ষণ প্রকাশিত হতে পারে। এমতাবস্থায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রকৃতপক্ষে বাতজ্বরের সংক্রমণ হয়েছে কিনা। নিচে বাতজ্বরের লক্ষণ সমূহ তুলে ধরা হলো:

  • জ্বর ও শরীর ব্যথা
  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ (Fatigue)
  • কাজেকর্মে অনীহা প্রকাশ পায়
  • হার্ট বিট বেড়ে যায়
  • মাংসপেশীতে কাঁপুনি (Twitching)
  • ত্বকে লাল‌ বর্ণের চাকা বিশেষত বুকে ও পিঠের দিকে

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) এর তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৭৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে বাতজ্বরের প্রধান লক্ষণ হিসেবে দেখা যায় জয়েন্টে ব্যথা। বিশেষত শরীরের বড় বড় জয়েন্ট গুলো (যেমন: হাঁটু, গোড়ালি, কনুই, কব্জি ইত্যাদি) থেকে ব্যথা শুরু হয় এবং নড়াচড়া করলে ব্যথা বৃদ্ধি পায়।‌ (Newman, 2018)

উল্লেখ্য শিশুদের ক্ষেত্রে স্কারলেট ফিভার সন্দেহে কখন শিশুকে ডাক্তার দেখানো উচিত সেই ব্যাপারে রয়েছে বিশেষ নির্দেশনা যা নিচে তুলে করা হলো:

  • নবজাতক থেকে শুরু করে ৬ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত শিশুর ক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা বা জ্বর ১০০° ফারেনহাইট (৩৭.৮° সেলসিয়াস)
  • ৬ সপ্তাহ‌ থেকে ৬ মাস বয়সী বাচ্চাদের জন্য ১০১° ফারেনহাইট বা তার বেশি জ্বর (৩৮.৩° সেলসিয়াস বা তার বেশি)
  • ৬ মাসের বেশি বয়সী বাচ্চাদের জন্য এক নাগাড়ে ৩ দিনের বেশি সময় ধরে জ্বর থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত (Johnson, 2018) 

 

বাতজ্বর কিভাবে ডায়াগনোসিস করা যায়?

শুধু লক্ষণ দেখে যেমন বাতজ্বর হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না তেমনি ভাবে বাতজ্বরের লক্ষণাবলীর সাথে অন্যান্য আরো অনেক রোগের লক্ষণাবলীর মিল রয়েছে। এই পর্যায়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে যে বাতজ্বর কিভাবে নির্ণয় করা হয়? সাধারণত বাতজ্বর নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী নিম্নলিখিত পরীক্ষা নিরীক্ষা সমূহ করানোর প্রয়োজন হয়ে থাকে। যেমন:

  • প্রথমত রোগীর রোগ লক্ষণের বর্ণনা ও বংশগত ইতিহাস জানার পরে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ (Physical examination) করা
  • রক্ত‌ পরীক্ষা যেমন: CBC (Complete blood cell count), ASO (antistreptolysin O) titre, CRP (C-reactive protien)
  • বুকের এক্সরে (chest x-ray)
  • ইসিজি (ECG- Electrocardiogram)

 

বাতজ্বর এর কার্যকরী চিকিৎসা

পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে বাতজ্বরের সংক্রমণ নিশ্চিত হলে সেক্ষেত্রে একজন বাতজ্বর বিশেষজ্ঞ (Rheumatologist) চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করা উচিত। সাধারণত বাতজ্বরের চিকিৎসায় লক্ষ্য থাকে স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস ও রোগ লক্ষণের উপশম করা এবং সেই সাথে পুনরায় বাতজ্বরের সংক্রমণ (Recurrences of Rheumatic Fever) যেনো না হয় সেদিকে। কারণ বাতজ্বরের ক্ষেত্রে প্রায়ই পুনরায় সংক্রমণ বা রোগ লক্ষণের ফিরে আসা দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণত বাতজ্বরের জন্য নিম্নলিখিত চিকিৎসা ব্যবস্থা সমূহ ‌নির্দেশিত হয়ে থাকে। যেমন:

বিশ্রাম:

বাতজ্বরে আক্রান্ত রোগীর জন্য সর্বপ্রথম নির্দেশনা হলো বিশ্রাম নিতে হবে। বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ গুলো (যেমন: প্রদাহ ও জয়েন্ট সমূহের ব্যথা) দূর না হওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিশ্রামে (Complete bed rest) থাকা‌ জরুরি। কারণ এই সমস্ত লক্ষণ গুলো বিশেষত জয়েন্টের ব্যথা কাজকর্ম করলে বা নড়াচড়ার ফলে বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও শিশুদের ক্ষেত্রে অধিক জ্বর দেখা দিলে বিশ্রামের সাথে সাথে বিশেষ যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

এন্টি-বায়োটিক (Antibiotics):

যেহেতু বাতজ্বর একটি ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ আর তাই এই রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রধান হাতিয়ার হলো এন্টি-বায়োটিক ওষুধ যা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। সাধারণত বাতজ্বরের চিকিৎসায় এন্টি-বায়োটিক হিসেবে পেনিসিলিন (Penicillin) ওষুধটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শরীরের মধ্যে থাকা স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে ১৪ দিন পর্যন্ত এন্টি-বায়োটিক ওষুধ সেবনের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন: পুনরায় সংক্রমণ রোধ করতে) দীর্ঘ সময় ধরে ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। মনে রাখতে হবে এন্টি-বায়োটিক ওষুধ সেবনের ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলা উচিত।

এন্টি-বায়োটিক ওষুধ সম্পর্কিত আরো দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিচে উল্লেখ করা হলো যা সকলের জন্যই জেনে রাখা জরুরি। যেমন:

১। অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধের সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করতে হবে। অন্যথায় তা এন্টি-বায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (Antibiotic resistance) এর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে যা অত্যন্ত বিপজ্জনক ও মারাত্মক একটি সমস্যা।

২। ওষুধ সেবনের মধ্যবর্তী দূরত্ব নির্দিষ্ট হতে হবে অর্থাৎ দিনে দুই বার ওষুধ সেবন করার ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী দূরত্ব বারো (১২) ঘন্টা হওয়া উচিত। এবং সেই সাথে প্রত্যেক দিন একই সময়ে ওষুধ সেবন করতে হবে।

 

প্রদাহ নাশক ওষুধ (Anti inflammatory drugs):

জ্বর, প্রদাহ ও জয়েন্টের ব্যথা নিরাময়ের জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী অথবা ওটিসি (OTC – over the counter) মেডিসিন হিসেবে প্যারাসিটামল (Paracetamol), আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) অথবা ন্যাপ্রোক্সেন (Naproxen) সেবন করা যেতে পারে। জ্বর বেশি থাকলে সেক্ষেত্রে প্যারাসিটামল সবচেয়ে ভালো কার্যকরী হয়। তবে বাতজ্বরের ক্ষেত্রে জ্বরের তুলনায় জয়েন্টে ব্যথা বেশি থাকলে ন্যাপ্রোক্সেন সেবন করা উত্তম। এক্ষেত্রে ৫০০ মিলিগ্রাম (500 mg) মাত্রায় দৈনিক ২ বার ন্যাপ্রোক্সেন ওষুধটি সেবন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে।

 

প্যারাসিটামল ওষুধ সেবনের ব্যাপারে যথাযথ নির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় সকল তথ্য জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

 

স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ (Corticosteroids):

সাধারণ প্রদাহ নাশক ওষুধ সেবনের মাধ্যমে প্রদাহ দূর না হলে সেক্ষেত্রে স্টেরয়েড জাতীয় প্রদাহ নাশক ওষুধ (যাকে মেডিকেলের ভাষায় Corticosteroids বলা হয়) সেবন করার প্রয়োজন হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিমিত মাত্রায় ওষুধ সেবন করা উচিত। কেননা স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবনের মাধ্যমে খুব ভালো ফলাফল পাওয়া গেলেও এই জাতীয় ঔষধ শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কারণ এর রয়েছে নানাবিধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন ওজন বেড়ে যাওয়া,‌ অনিদ্রা, ব্রণ হওয়া, পায়ে পানি জমে যাওয়া ইত্যাদি।

এসপিরিন (Aspirin):

এটিও একধরনের প্রদাহ নাশক ওষুধ যা সাধারণত ১৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য নির্দেশিত হয় না। কারণ তাতে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো বিশেষত লিভার ও মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে বাতজ্বরের ক্ষেত্রে চিকিৎসক যদি প্রয়োজন মনে করেন তবে সেক্ষেত্রে ক্ষতির সম্ভাবনা উপেক্ষা করে এসপিরিন সেবনের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। (Newman, 2018)

অন্যান্য:

বাতজ্বর জনিত স্নায়ুবিক সমস্যা যেমন মাংসপেশীর অস্বাভাবিক সংকোচন প্রসারণ অথবা খিঁচুনি (Seizure) দেখা দিলে তখন নিম্নলিখিত ওষুধ সমূহ সেবন করার প্রয়োজন হয়ে থাকে। যেমন:

  1. Valproic acid
  2. Carbamazepine
  3. Haloperidol
  4. Risperidone

তবে এই ওষুধ গুলো ওটিসি (OTC) গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত নয় ফলে চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়াই নিজে নিজে সংগ্রহ ও সেবন করা যায় না। বরং এই ওষুধ গুলো শুধু মাত্র চিকিৎসকের নির্দেশনা (Prescription) অনুযায়ী সেবন করা উচিত।

 

বাংলাদেশে বাতজ্বরের চিকিৎসা 

বাংলাদেশের প্রায় সকল সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বাতজ্বর নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা ও যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও বিশেষ চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে রয়েছে “জাতীয় বাতজ্বর ও হ্নদরোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র” যা শেরে বাংলা নগর, ঢাকায় অবস্থিত। আরো রয়েছে এন্টি-বায়োটিক সহ বাতজ্বর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ওষুধের পর্যাপ্ততা। তবে একটি সাধারণ সমস্যা রয়েছে আর তা হলো এন্টি-বায়োটিক ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনতার ঘাটতি।

উল্লেখ্য বাংলাদেশে শুধুমাত্র বাতজ্বর বিশেষজ্ঞ (Rheumatologist) চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া যায় না। অধিকাংশ সময়েই একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অথবা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই বাতজ্বর বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকেন। তবে এতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই কারণ বাতজ্বরের সাথে হৃদরোগের বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে। আর তাই একজন চিকিৎসক একই সাথে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও বাতজ্বর বিশেষজ্ঞ হতে পারেন। তেমনি ভাবে একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ একই সাথে বাতজ্বর বিশেষজ্ঞ হয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে পারেন।

 

বাতজ্বরের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি 

বাতজ্বরের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি 

বাতজ্বরের চিকিৎসায় বিকল্প ধারার চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে হোমিওপ্যাথি (Homeopathy) কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। ব্রিটিশ হোমিওপ্যাথিক এসোসিয়েশন (British Homeopathic Association) এর তথ্য অনুযায়ী হোমিওপ্যাথি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি যা প্রায় সকল ধরনের রোগের চিকিৎসায় কার্যকরী ভূমিকা রাখে।‌ (Hahn, 2013) এবং সেই সাথে এই চিকিৎসা পদ্ধতির একটি বিশেষ বিশেষত্ব হলো এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side effects) নেই বললেই চলে যা এই চিকিৎসা পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার পেছনের এক‌ অন্যতম প্রধান কারণ।

বাতজ্বরের চিকিৎসায় সাধারণত নিম্নলিখিত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ গুলো নির্দেশিত হয়ে থাকে।‌ যেমন:

  • Belladonna
  • Arnica Montana
  • Hepar sulf
  • Bryonia alb
  • Phytolacca
  • Rhus tox
  • Thuja occ etc.

এছাড়াও রোগীর রোগ লক্ষণের উপর নির্ভর করে আরো অন্যান্য ওষুধ নির্দেশিত হতে পারে। বাতজ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত সকল ধরনের হোমিওপ্যাথিক ওষুধ বাংলাদেশের প্রায় সকল হোমিও চেম্বার বা হোমিও ফার্মেসিতে পাওয়া যায়। তবে সকল ক্ষেত্রেই একজন রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা উচিত।

বাতজ্বর এ পরবর্তীতে কি কি জটিলতা হতে পারে?

বাতজ্বরের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়াবহ ধরনের সমস্যা ‌হলো বাতজ্বর পরবর্তী জটিলতা (Complication) কারণ এটি সাধারণত হার্টের সমস্যা (carditis or valvulitis) সৃষ্টি করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ (NIH of US) এর‌ তথ্য অনুযায়ী বাতজ্বর পরবর্তী প্রায় ৫০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে হার্টের সমস্যা হতে পারে এবং তা সবচেয়ে বেশি হারে হতে দেখা যায় কম বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। এই তালিকায় কম ঝুঁকিতে রয়েছে উন্নত দেশ‌গুলো অর্থাৎ উন্নত দেশগুলোতে বাতজ্বর পরবর্তী জটিলতা হিসেবে হার্টের সমস্যা কম হয়ে থাকে। এর কারণ হলো স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা, বাতজ্বরের চিকিৎসায় যথাযথ ভাবে এন্টি বায়োটিক ওষুধ সেবন করা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো ইত্যাদি। (Newman, 2018)

বাতজ্বর জনিত হার্টের সমস্যায় (Rheumatic heart disease) সাধারণত হার্টের ভাল্ব (Valve) অথবা হার্টের পেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। বাতজ্বরের কারণে সৃষ্ট হার্টের এই সমস্যা গুলো কোনো সাময়িক সমস্যা নয় বরং তা জটিলতর হার্টের রোগ। একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না‌ হলে একসময় তা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

  • Valvular stenosis: হার্টের মধ্যে বিশেষ একধরনের ভাল্ব বা কপাটিকা (Valve) থাকে যা সঠিক ভাবে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। Valvular stenosis হলো এমন এক‌ অবস্থা যেখানে হার্টের ভাল্ব অস্বাভাবিক ভাবে সংকোচিত হয়ে যায় আর যার দরুন সঠিক ভাবে রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে।
  • Valvular regurgitation: এটিও একটি ভাল্ব (valve) এর রোগ যেখানে হার্টের মধ্যে রক্ত উল্টো দিকে গমন করে থাকে যা সম্পূর্ণ ভাবে অস্বাভাবিক এবং একটি জটিলতর সমস্যা।
  • অন্যান্য: হার্টের পেশী ক্ষতিগ্রস্ত (Heart muscle damage) হওয়ার দরুন হার্ট ‌সঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না। যার ফলে হার্ট ফেইলিউর (Heart failure) এর মত প্রাণঘাতী সমস্যার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এছাড়াও বাতজ্বরের জটিলতা হিসেবে ‌হার্টের স্বাভাবিক ছন্দ (heart rhythm) বিঘ্নিত হতে পারে আর যার‌ ফলে স্ট্রোক এর ঝুঁকি বেড়ে যায়।

রিউমেটিক ফিভার (বাতজ্বর) এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস

বাতজ্বর ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid arthritis) উভয় ক্ষেত্রেই জয়েন্টে ব্যথা হয় আর তাই অনেকেই মনে করে থাকেন হয়তো এই রোগ দুটির মধ্যে কোনো বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে। বস্তুত এই রোগ দুটি একটি অপরটির থেকে আলাদা এবং সেই সাথে বাতজ্বর পরবর্তীতে জটিলতা হিসেবে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হতে পারে এই ধারণা সম্পূর্ণ রূপে ভুল।

উল্লেখ্য বাতজ্বর পরবর্তী জটিলতার জন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের (Cardiologist) পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। ক্ষেত্রে বিশেষে শল্যচিকিৎসার (Surgery) প্রয়োজন হতে পারে। তবে এই জটিলতা এড়াতে অর্থাৎ বাতজ্বর পরবর্তীতে যেনো হার্টের সমস্যা না হয় তার জন্য বাতজ্বরের যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় এন্টি বায়োটিক ওষুধ সেবন এবং নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর মাধ্যমে বাতজ্বর পরবর্তী জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করা যায়।

Rheumatoid arthritis

দীর্ঘদিন বাতজ্বর এর কারণে রোগীর চেহারায় কোন পরিবর্তন আসে কি?

সাধারণত বাতজ্বরের লক্ষণ সমূহ দীর্ঘদিন যাবত স্থায়ী হয় না।‌ কয়েক মাস থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত বাতজ্বরের লক্ষণ থাকে। এর পর আপনা আপনি লক্ষণ চলে যায় কিন্তু পরবর্তীতে জটিলতর সমস্যা যেমন হার্টের রোগ নিয়ে হাজির হতে পারে।

যা হোক দীর্ঘদিন বাতজ্বর এর কারণে রোগীর চেহারায় কোনো পরিবর্তন আসে কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, হ্যাঁ কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন:

  • বাতজ্বরের কারণে ত্বকে লাল বর্ণের চাকা হতে পারে যা চেহারার জন্য সৌন্দর্য হানিকর হয়ে দাঁড়ায়
  • ত্বকে অস্বাভাবিক রকমের ছোপ ছোপ দাগ হতে পারে (Blotchy)
  • বাতজ্বরের চিকিৎসায় দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড (Corticosteroids) ওষুধ গ্রহণের প্রয়োজন হয়। আর এই ধরনের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মুখে ব্রণ (Acne) হতে পারে

উল্লেখ্য বাতজ্বর জনিত ত্বক ও চেহারার পরিবর্তন নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ এটি একটি সাময়িক সমস্যা যা স্থায়ী ভাবে কোনো ক্ষতি করে না। অর্থাৎ রোগ ভালো হয়ে গেলে বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন বন্ধ করে দিলে আপনাআপনিই এই সমস্যা গুলো দূর হয়ে যায়।

বাতজ্বর কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?

বাতজ্বর একটি ‌জটিলতর স্বাস্থ্য সমস্যা যার প্রভাবে প্রাণঘাতী হার্টের রোগ যেমন হার্ট ফেইলিউর ও স্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে। আর তাই এই রোগ যেনো না‌ হয় সেটা সবারই কাম্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো যে বাতজ্বর প্রতিরোধ করার জন্য কোনো প্রতিরোধমূলক টিকা (Vaccine) ব্যবস্থা নেই। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন যা বাতজ্বর প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। (Johnson, 2018)

প্রথমত শিশুদের ক্ষেত্রে জ্বর (Scarlet fever) অথবা গলায় ইনফেকশন দেখা দিলে অবহেলা না করে যত দ্রুত সম্ভব একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ বা নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ (ENT specialist) চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। অতঃপর চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়মিত এন্টি-বায়োটিক ওষুধ সেবন করতে হবে। কখনোই গলায় ইনফেকশনের চিকিৎসায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হয়ে নিজে নিজে ফার্মেসি থেকে এন্টি-বায়োটিক ওষুধ সেবন করা যাবে না। মনে রাখবেন গলায় ইনফেকশনের যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে তা বাতজ্বরের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্যবিধি (Hygiene) মেনে চলার মাধ্যমে বাতজ্বরের সংক্রমণ কমানো যেতে পারে। যেমন:

  • হাঁচি ও কাশি দেওয়ার সময় রুমাল, টিস্যু অথবা হাতের কনুই ভাঁজ করে মুখ ঢেকে নিতে হবে
  • জীবাণু নাশক সাবান অথবা হ্যান্ডওয়াশ (Handwash) দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে
  • অসুস্থ মানুষের ব্যবহৃত জামা কাপড় অথবা তোয়ালে ব্যবহার করা যাবে না

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বাতজ্বর একটি জটিলতর সমস্যা। কিন্তু ‌আশার কথা হলো এই যে আমাদের দেশে রয়েছে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা যা যথাসময়ে এবং যথাযথ ভাবে গ্রহণ করা হলে বাতজ্বরের প্রকোপ যেমন কমিয়ে আনা সম্ভব তেমনি ভাবে বাতজ্বর পরবর্তী জটিলতা হ্রাস করা সম্ভব হবে। তবে এর জন্য প্রয়োজন বাতজ্বর সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতা আর সেই সাথে গলায় ইনফেকশন বা স্কারলেট ফিভার সংক্রমণের সাথে সাথে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

 

 

 

 

References

Hahn, R. (2013). The evidence for homeopathy. Retrieved from British Homeopathic Association: www.homeopathy-uk.org/treatment/evidence-for-homeopathy

Johnson, S. (2018, September 29). Rheumatic Fever. Retrieved from Healthline: www.healthline.com/health/rheumatic-fever

Newman, T. (2018, January 10). Rheumatic fever: What you need to know. Retrieved from Medical news today: www.medicalnewstoday.com/articles/176648

 

Last Updated on April 15, 2023