ত্বকের যত্ন বা স্কিন কেয়ারের সাথে সম্পর্কিত শব্দ যুগল ‘ফেইস সিরাম’ আজকাল বেশ পরিচিত। এটি এমন একটি স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট, যা ফেইস ওয়াশ দিয়ে মুখ ধোয়ার পর এবং ময়েশ্চারাইজার ব্যবহারের আগে ত্বকে লাগাতে হয়। অনেকেই ভাবেন, ফেইস সিরামের আসলে তেমন গুরুত্ব নেই, কিংবা এটি অযথা টাকা খরচ। তবে বাস্তব হচ্ছে, ত্বকের বলিরেখা, মলিনতা, দাগ ইত্যাদি নানান সমস্যায় ফেইস সিরাম ত্বকের গভীরে গিয়ে কাজ করে জাদুর মতো। 

উপাদান ভেদে সিরামেরও আছে নানান প্রকারভেদ। একেক ধরণের ত্বকের জন্য একেক কার্যকরী উপাদানের সিরাম পাওয়া যায়। আজকে জানবো ভিটামিন-সি যুক্ত সিরামের খুঁটিনাটি।  

ভিটামিন-সি সিরাম কি?

ত্বকের একটি প্রিয় উপাদান হচ্ছে ভিটামিন-সি। যা বিজ্ঞান সমর্থিতও। ব্রনের দাগ মেটানো থেকে শুরু করে, বলিরেখা, অতিরিক্ত তৈলাক্ত ভাব, রোদে পোড়া ভাব দূর করা, ত্বকের উজ্জ্বলতা বজায় রাখা ইত্যাদির মতো নানান উপকারী ক্ষমতা রয়েছে ভিটামিন-সি এর।  

এইসব উপকারী দিকের কথা ভেবে ভিটামিন-সি যুক্ত ফলমূল যেমন, লেবু, কমলা ইত্যাদি আবার সরাসরি ত্বকে মাখা চলবে না। কারণ এগুলোতে থাকা এসিড কিন্তু ত্বকের চামড়া পুড়িয়েও দিতে পারে। তাহলে কীভাবে ত্বকের যত্নে ব্যবহার করবেন ভিটামিন-সি? এই প্রশ্নের উত্তরই হচ্ছে ভিটামিন-সি সিরাম। যা ত্বকে সঠিক উপায়ে ব্যবহারের মাধ্যমে পাওয়া যাবে ভিটামিন-সি এর সব গুনাগুন।

ভিটামিন-সি সিরামের উপকারিতা 

১. ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে

সতেজ, মসৃণ ও টানটান থাকার জন্য আমাদের ত্বকের চাই প্রচুর আর্দ্রতা। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খেয়ে সারা শরীরের আর্দ্রতা ধরে রাখা সম্ভব। তবে সেই পানি সারা শরীরে সমানভাবে ভাগ হয়ে যাওয়ায়, ত্বক অনেকসময় শুষ্কতায় ভোগে। আর ভিটামিন-সি সিরামের আছে এমন ক্ষমতা, যা ত্বকের আর্দ্রতাকে বাইরে থেকে গভীর পর্যন্ত ধরে রাখতে সাহায্য করে। এতে ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক হওয়া থেকে রক্ষা পায়, শুষ্কতার কারনে মসৃণতা হারাতে পারে না ত্বক।  

২. ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়

ফর্সা থেকে শ্যামলা, সবার ত্বকেরই নিজস্ব একটা রং থাকে। ত্বকের রঙের ভিন্নতা নির্ভর করে ‘মেলানিন’ নামক উপাদানের উপর। ত্বকের রং যাই হোক না কেন, সাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বক সব থেকে সুন্দর দেখায়। কিন্তু বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ কোন কারনে যদি মেলানিনের উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়, তাহলে ত্বকের রং স্বাভাবিকের চেয়েও কালশে দেখায়। হারায় ত্বকের উজ্জ্বলতা। চেহারার আলাদা আলাদা যায়গার বর্ণেও দেখা যেতে পারে ভিন্নতা। যাকে বলে ‘হাইপারপিগমেন্টেশন’। ত্বকে ভিটামিন-সি সিরাম ব্যবহারের মাধ্যমে এই মেলানিন উৎপাদনের হার কার্যকরীভাবে কমানো সম্ভব। যার ফলে বৃদ্ধি পায় ত্বকের উজ্জ্বলতা। ত্বকের রঙ হয় সবদিকে সমান। 

৩. সেনসেটিভ ত্বকের অস্বস্তি কমায়

অনেকের ত্বক এতটাই সংবেদনশীল হয় যে, আবহাওয়া, খাওয়া-দাওয়া বা পারিপার্শ্বিক যে কোন কিছুর প্রতিক্রিয়াতে সহজেই অক্সিডাইজ হয়, লালচে ভাব দেখা দেয়। এমনকি র‍্যাশ, জ্বালাপোড়াও হতে পারে। যা থেকে পরবর্তীতে ত্বকে স্থায়ী ক্ষতি বা দাগ হয়ে যায়। ভিটামিন-সি এর রয়েছে এন্টি ইনফ্ল্যামেটরি ক্ষমতা। ফলে সংবেদনশীল ত্বকে ভিটামিন-সি সিরাম ব্যবহারের মাধ্যমে ত্বকের এসকল কষ্ট ও অস্বস্তি কমানো সম্ভব। 

. ত্বকের দাগ দূর করতে কার্যকরী 

পুরনো ক্ষত থেকে তৈরি হওয়া দাগ, একনি বা ব্রনের দাগ ইত্যাদি ধীরে ধীরে কমে আসে নিয়মিত ভিটামিন-সি সিরাম ত্বকে ব্যবহার করলে। মূলত এসব দাগ ক্ষতস্থানে মেলানিন জমাট বেধে তৈরি হয়। ওই স্থানের অতিরিক্ত মেলানিন ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার মাধ্যমে ভিটামিন-সি সিরাম দিতে পারে দাগহীন, মসৃণ ত্বক। এর এন্টি-ব্যাক্টেরিয়াল ক্ষমতা নতুন করে একনি বা ব্রন হওয়াও রোধ করে। 

৫. রোদে পোড়াভাব দূর করে

প্রচণ্ড রোদে সানস্ক্রিন ছাড়া ত্বক উন্মুক্ত থাকলে, সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি ও ফ্রি-র‍্যাডিকেলের প্রভাবে ত্বক পুড়ে যায়। যাকে আমরা সানট্যান বলি। এতে ত্বকের কোষ ভেতর থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে, লালচে বা কালচে রং ধারণ করার পাশাপাশি হয় জ্বালাপোড়াও। যথাসময়ে এই পোড়াভাব না কমালে প্রদাহ বাড়ার পাশাপাশি, স্থায়ী হয়ে যেতে পারে ত্বকের কালচে রং। এমনকি গড়াতে পারে ত্বকের ক্যান্সার পর্যন্ত। 

সানস্ক্রিন ব্যবহারের অভ্যাসের পাশাপাশি ভিটামিন-সি সিরাম নিয়মিত ত্বকের যত্নে ব্যবহার করলে, এর এন্টি-অক্সিডেন্ট ত্বকের ক্ষতিগ্রস্থ কোষগুলিকে ভেতর থেকে মেরামত করে। ভেতর থেকে রোদে ক্ষতিগ্রস্থ ত্বকের উন্নতির পাশাপাশি মিটে যায় উপরিভাগের সানট্যান বা পোড়া ভাবও। 

৬. ডার্ক সার্কেল ও বার্ধক্যের ছাপ দূর করে

চোখের নিচের কালো দাগ ও বয়স বাড়ার বিভিন্ন লক্ষণ যেমন, বলিরেখা, চামড়ার ভাঁজ ইত্যাদি দূর করতে প্রচণ্ড কার্যকরী ভিটামিন-সি সিরাম। বয়স বাড়ার সাথে মানুষের শরীরের প্রাকৃতিক কোলাজেন কমতে থাকে। শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে ত্বকেও দেখা যায় এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। অনেকের ত্বক বয়সের আগেই কোলাজেনের অভাবে দুর্বল হয়ে যেতে থাকে, এমনকি মরেও যেতে থাকে ত্বকের অনেক কোষ। যার ফলাফলই ত্বকে কালচে ছোপ, বলিরেখা, চামড়া ঝুলে যাওয়া ইত্যাদি। ভিটামিন-সি এর এন্টি অক্সিডেন্ট ত্বকের কোষে প্রাকৃতিকভাবে কোলাজেনের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। ত্বক ধরে রাখতে পারে তাঁর তারুণ্য।  

৭. ইনফেকশন রোধ করে

ত্বকের ছোটখাটো ব্রন বা একনি অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। যা থেকে হতে পারে ক্ষত ও ইনফেকশন পর্যন্ত! ব্রন বা একনিতে থাকা জীবাণু ধ্বংসে ভিটামিন-সি ভূমিকা রাখে। তাই নিয়মিত সঠিক নিয়মে ভিটামিন-সি সিরাম ব্যবহারে এধরণের ব্রন বা একনি দ্রুত শুকিয়ে ভালো হতে থাকে। জীবাণুর আক্রমনে হওয়া ইনফেকশনও রোধ করে সিরামের ভিটামিন-সি। 

(Patel, 2023)

কীভাবে ভিটামিন-সি সিরাম ব্যবহার করবেন?

vcserum2

ত্বকে যে কোন জিনিস ব্যবহারের পূর্বে সেটির সকল উপাদান এবং ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে ভালভাবে জেনে নেয়া জরুরী। 

  • ব্যবহারের পূর্বে ভিটামিন-সি সিরামের বোতলে থাকা মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ দেখে নিতে হবে। সেই তারিখের পর কোনভাবেই সিরাম ব্যবহার করা যাবে না। 
  • আপনার ত্বকে ভিটামিন-সি সিরাম কোন এলার্জি বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখাবে কি না নিশ্চিত হওয়ার জন্য ত্বকে অল্প জায়গা জুড়ে এটি লাগিয়ে দেখতে হবে। ২৪ ঘন্টায় কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না হলে, নিশ্চিন্তে ব্যবহার করতে পারেন ভিটামিন-সি সিরাম। 
  • ত্বকে সহজে মানিয়ে যাওয়ার জন্য, শুরুর দিকে খুবই অল্প পরিমাণে সিরাম নিয়ে ব্যবহার শুরু করতে হবে। কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকলে, ধীরে ধীরে পরিমাণ বাড়ানো যাবে। 
  • অবশ্যই পরিষ্কার মুখে সিরাম ব্যবহার করতে হবে। তাই প্রতিবার ভিটামিন-সি ব্যবহারের পূর্বে ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে ত্বক পরিষ্কার করে নিতে হবে।
  • সিরাম ব্যবহারের কিছুক্ষন পর আপনার মুখের জন্য মানানসই এমন ভালো মানের কোন ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে।
  • সিরামের সাথে ত্বকে ব্যবহার করা অন্য পণ্যগুলিতে “নায়াসিনামাইড” নামক উপাদানের উপস্থিতি আছে কি না দেখতে হবে। কারণ নায়াসিনামাইড ভিটামিন-সি এর কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। 
  • দিনের বেলা ঘর থেকে বের হলে অবশ্যই সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। 

সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ঝুঁকি

একেক জন মানুষের ত্বক একেক রকম। ত্বকের ভিন্নতায় একেক ত্বকে একেক উপাদান খুব ভালো যেমন কাজ করতে পারে, তেমনি কোন উপাদানকে কোন ত্বক ভালভাবে গ্রহন নাও করতে পারে। হতে পারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। জেনে রাখুন ভিটামিন সি সিরামের এমনই কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যেগুলো দেখা দেওয়া মাত্রই বন্ধ করে দিতে হবে এর ব্যবহার।

  • চুলকানি
  • লাল র‍্যাশ
  • জ্বালাপোড়া
  • কোন কোন স্থানে শিরশিরে অনুভূতি 
  • ত্বক ফুলে ওঠা (Cobb, 2019)

ভালো মানের কয়েকটি ভিটামিন-সি সিরাম

ভিটামিন-সি সিরামের বিষয়ে খুঁটিনাটি তো জানা হলোই। এবার জেনে নেয়া যাক বাজারে পাওয়া যাওয়া ভিটামিন-সি যুক্ত কয়েকটি ভালো মানের সিরামের নাম। 

যুগ যুগ ধরে ত্বকের যত্নে একটি বিশাল অংশ জুড়ে আছে ভিটামিন-সি। ত্বক সহ পুরো শরীরের যত্নেই ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার খাওয়ার কোন বিকল্প নেই। তবে শরীরের ভেতরের সাথে শরীরের উপরিভাগ, অর্থাৎ ত্বককে ভালো রাখতে বাইরে থেকেও কিছু যত্নের খুব প্রয়োজন। আর আপনার ত্বকের এই বাড়তি যত্নের কাজটিই করতে সক্ষম ভিটামিন-সি সিরাম।

References

Patel R. (2023, February 3) 11 Reasons to Add Vitamin C Serum to Your Skin Care Routine, Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/beauty-skin-care/vitamin-c-serum-benefits 

Cobb C. (2019, July 19) Top 3 benefits of vitamin C serum, Retrieved from MedicalNewsToday: https://www.medicalnewstoday.com/articles/325801 

Last Updated on April 9, 2023