হঠাৎ কানে ব্যথা হলে করণীয় কি?

ধরুন, মাঝরাতে হঠাৎ তীব্র কানের ব্যাথা নিয়ে জেগে উঠলো আপনার ছোট্ট বাবুটা অথবা আপনি নিজেই জেগে উঠলেন তীব্র কান ব্যাথা নিয়ে, এমতাবস্থায় কি করবেন? নিঃসন্দেহে এটি দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার মতো জরুরি অবস্থা নয়, আবার ব্যথা এতো তীব্র প্রকৃতির যে, তা সহ্য করাও সম্ভব নয়।

এমন পরিস্থিতিতে কতিপয় ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে কানের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, যা এই অনুচ্ছেদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। সেই সাথে কানের ব্যাথা কমানোর উপায় হিসেবে আগে থেকেই ঘরে কি কি ওষুধ কিনে রাখা উচিত সেই বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।‌

কানের ব্যাথা কেন হয়?

কান ব্যাথা হলে কি করণীয় সেই বিষয়ে জানার পূর্বে কেন হয় এই যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা তা জানা জরুরি। সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর জন্য কান ব্যাথা হয়ে থাকে। যেমনঃ

  • কানের ভেতর ময়লা (earwax)
  • কানে ইনফেকশন (acute otitis media)
  • সাইনাস ইনফেকশন (sinus infections)
  • কানের ভেতরে পানি যাওয়া
  • উঁচুতে আরোহণ (যেমনঃ বিমানে চলাচল অথবা পাহাড়ে উঠার সময় উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বায়ুর চাপ কমে যায় যা কানে ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে)
  • এছাড়াও টনসিল বেড়ে যাওয়া অথবা দাঁতের ব্যথা কানের দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

কানের ব্যাথা কমানোর ঘরোয়া উপায়

কানের ব্যাথা কমানোর ঘরোয়া উপায়

কানের ব্যাথায় করনীয় বিষয়াবলী সমূহ (একটি বিশেষ পদ্ধতি সহ “৭ নাম্বার”) নিচে ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরা হলো- (Goldman, 2018)

১. ঠান্ডা অথবা গরম সেঁক

ফ্রিজ থেকে কয়েক টুকরো বরফ বের করে তা একটু কাপড়ে পেঁচিয়ে কানের উপরে কিছুক্ষণ ধরে থাকুন। এই ফাঁকে কিছুটা পানি গরম করে তা ‘হট ওয়াটার ব্যাগ’ এ নিন অথবা এমন ব্যাগ না‌ থাকলে একটা রুমাল চুলা বা ইস্ত্রির সাহায্যে গরম করুন। বরফের ঠান্ডা এবং গরমের সেঁক ১০ মিনিট পর পর পর্যায়ক্রমে দিতে থাকুন। আশা করা যায়, এই পদ্ধতিতে ব্যথা কমে যাবে। তবে আপনার ক্ষেত্রে যদি শুধু গরম বা শুধু ঠাণ্ডা দিলে ভালো লাগে, তাহলে যে কোন একটিও ব্যবহার করতে পারবেন।

২. ওলিভ অয়েল

কানের মধ্যে ময়লা থাকলে বা কানে ফাংগাল ইনফেকশনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক নিরাময়ের জন্য ওলিভ অয়েল ব্যবহার করলে কানের ব্যাথা কমে যায়। এক্ষেত্রে তেল‌ সামান্য গরম করে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। কানের ব্যথা কমাতে ছোট বড় সকলের জন্য ওলিভ অয়েলের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিরাপদ।

৩. উচু বালিশে শোয়া

রাতের বেলায় শুয়ে যেকোনো এক কানে ব্যথা হলে ব্যথার পাশে চেপে‌ না শুয়ে বরং অন্যদিকে কাত হয়ে শুয়ে থাকুন।‌ এতেও ব্যথা না কমলে অতিরিক্ত বালিশ নিয়ে মাথা উঁচু করে শুয়ে দেখতে পারেন। অন্যথায় কোনো কিছুর সাথে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে মাথা সোজা রেখে কিছুক্ষণ বসে থাকুন।‌

৪. আদা, রসুন, পেঁয়াজ

সামান্য একটু আদা বা পেঁয়াজ অথবা রসুন ছেঁচে রস বের করে ২/৩ ফোঁটা রস কানের মধ্যে দিন। এতে করে কান ব্যাথা কমে যেতে পারে কারণ আদা, পেঁয়াজ এবং রসুনের মধ্যে প্রদাহ নাশক গুণাবলী (Anti-inflammatory) রয়েছে।

৫. মায়ের বুকের দুধ

শিশুদের ক্ষেত্রে কানের ব্যাথা কমাতে মায়ের বুকের দুধ সামান্য পরিমাণে বের করে কানের মধ্যে দেওয়ার মাধ্যমে উপকার পাওয়া যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে উপকার যদি পাওয়া নাও যায়, এতে কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। (Villines, 2021)

৬. চুয়িং গাম

উঁচুতে আরোহন তথা বিমানে চলার সময় অথবা পরে কান‌ ব্যথার প্রতিকার এবং প্রতিরোধের জন্য চুয়িংগাম চেবানো উপকারী হতে পারে।

৭. লবণ দিয়ে কানের ব্যাথা কমানোর উপায়

লবণ দিয়ে কানের ব্যাথা কমানোর উপায়

লবণ এমন একটি বস্তু যার স্বাদ এবং পুষ্টিগুণ সম্পর্কে আমরা সকলেই জানি। রান্নাঘরে যেমন এর আছে অপরিহার্য ব্যবহার, তেমনি রয়েছে অনেক স্বাস্থ্যগুণ। এর উপকারিতা বলে শেষ করার মতো নয়। লবণকে প্রাচীনতম প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিকগুলির মধ্যে একটি বলে মনে করা হতো এবং প্রায়শই ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে চাইনিজরা বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে এটি ব্যবহার করে থাকে। কানের যেকোন চিকিৎসায় এর ব্যবহার অতুলনীয়।

যা যা লাগছেঃ

  • ১০০% সাদা সুতির মোজা এবং
  • অরগানিক সামুদ্রিক লবণ

সাদা ও সুতির মোজার কথা বলার কারণ হলো, মোজাটি যদি সাদা ও সুতির না হয়ে অন্য কোন রং এর হয় সেক্ষেত্রে মোজা থেকে রং উঠতে পারে যা কানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আবার সুতি না সিনথেটিকের হলে, তাপের সংস্পর্শে আসলে তা গলে যেতে পারে। সেই সাথে লবণটি অবশ্যই সমুদ্রের বড় দানাদার অরগানিক লবণ হতে হবে, অন্যথায় পিউরিফাই করা সূক্ষ্ম লবণ হলে তা মোজার ভেতরে রাখলে ছিদ্র দিয়ে পড়ে যেতে পারে।

কানে ব্যবহারের জন্য যেভাবে প্রস্তুত করবেনঃ

একটি ফ্রাই প্যানে আধা কাপ লবণ দিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য অথবা পুট পুট শব্দ শুরু না হওয়া পর্যন্ত গরম হতে দিন। এবার গরম হওয়া লবণ মোজার ভেতরে ঢালুন। লবণ ঢালা হয়ে গেলে মোজাটি গিঁট দিয়ে আটকে নিন এবং হালকা ঠান্ডা হওয়ার জন্য কিছুক্ষণ রেখে দিন। এবার হালকা গরম অবস্থায় লবণের পুটলিটা কানের উপরে ২০ মিনিটের জন্য ধরে রাখুন।

প্রয়োজন অনুযায়ী এভাবে আপনি দিনে কয়েকবার ব্যবহার করতে পারবেন। আর একবার ব্যবহার করা লবণ আরো ৩-৪ বার ব্যবহার করতে পারবেন। এভাবে দেয়া তাপ আপনার কানের ব্যাথা এবং ফোলাভাব কমাতে খুব দ্রুত কাজ করবে। অবশ্যই এভাবে ব্যবহার করার পর রান্নার ক্ষেত্রে সেই লবণ ব্যবহার করবেন না।

উল্লেখ্য, আপনি চাইলে প্রথমেই মোজার ভেতরে লবণ রেখে গিঁট দিয়ে ফ্রাই প্যানের উপর ঝুলিটি রেখে হালকা গরম করে কানের উপর রাখতে পারেন। আবার, সাদা মোজার পরিবর্তে হাতের কাছে থাকা পরিষ্কার সাদা কাপড়ের কোন ঝুলি বা সাদা সুতির কাপড় দিয়ে হাতের তৈরি কিছু দিয়ে এই প্রক্রিয়াটি করতে পারবেন।

কানের ব্যাথার ঔষধের নাম

কান ব্যাথা যেকোনো সময় এবং যে কারো ক্ষেত্রে হতে পারে আর তাই আগে থেকেই কিছু ওষুধ কিনে ঘরে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তবে এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ওটিসি মেডিসিনের অর্ন্তভুক্ত কিছু ব্যথা নাশক ওষুধ চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়াই কিনে রাখা এবং খাওয়া নিরাপদ হবে। যেমনঃ

প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন ৫০০ মিগ্রা মাত্রায় অথবা এসপিরিন ৩০০ মিগ্রা মাত্রায় একবার খেয়ে নিলেই যথেষ্ট। তবে ব্যথা না কমলে সেক্ষেত্রে দৈনিক ৩ থেকে ৪ বার একটি করে ট্যাবলেট খাওয়া যেতে পারে। মনে রাখবেন, কান ব্যাথা কমাতে ,কান ব্যাথার ওষুধ বা ট্যাবলেট হিসেবে যেকোনো একটি ওষুধ  খেতে হবে এবং ২ বছরের কমবয়সী বাচ্চাদের জন্য এসপিরিন খেতে দেওয়া যাবে না।

কানের ব্যাথার ড্রপের নাম

সাধারণত কানের মধ্যে ফাংগাস অথবা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিহত করতে ড্রপ ব্যবহার করা হয়।‌ তবে এই জাতীয় কানের ব্যাথার  ড্রপ নাম জেনে নিজে নিজেই কিনে‌ ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। আর তাই আপনার কানের জন্য একজন ‘নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ’ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ড্রপ ব্যবহার করুন।‌

কানের ব্যথা দূর করার দোয়া

কানের ব্যাথার দোয়া হিসেবে সহি বুখারী শরীফের এই দোয়াটি বেশ প্রসিদ্ধ-

উচ্চারণঃ আমসাহল বাসা রাব্বান্নাসি বিয়াদিকাশশিফা উলা কাশিফালাহু ইল্লাআংতা।

অর্থঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমার ব্যথা দূর করে দিন। আরোগ্য দানের ক্ষমতা শুধুমাত্র আপনারই হাতে। এই ব্যথা আপনি ছাড়া আর কেউ দূর করতে পারবে না।

কানের ব্যাথার হোমিও ঔষধ

হোমিওপ্যাথিতে কানের ব্যাথার ঔষুধ হিসেবে রয়েছে আর্ণিকা, ক্যামোমিলা, বেলাডোনা, হিপার সালফ, ম্যাগ ফস, ফেরাম ফস, পালসেটিলা, ভারবাসকাম থ্যাপসাস, সাইলিশিয়া, সোরিনাম ইত্যাদি। এই ওষুধগুলো সাধারণত কানে ব্যথার সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে বের করে সেই অনুযায়ী হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে থাকে। তবে চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়া ওটিসি মেডিসিনের মতো বেলেডোনা ওষুধটি হঠাৎ কানে ব্যথা শুরু হলে ৫ ফোঁটা করে কয়েকবার খেতে পারেন। এটি যেকোনো হোমিও ফার্মেসিতে Belladonna 200 নামে কিনতে পাবেন।‌

কানে ব্যথার প্রাথমিক পর্যায়ে ঘরোয়া সমাধান হিসেবে উল্লেখিত উপায় এবং ওষুধ গুলো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যথায়, জটিল সমস্যার ক্ষেত্রে একজন ‘নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ’ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আপনার সমস্যাটি জটিল কিনা তা যেভাবে বুঝবেন-

  • ২-৩ দিনের বেশি সময় ধরে ব্যথা
  • ব্যথার সাথে জ্বর বা মাথাব্যথা
  • কান থেকে রক্ত বা পুঁজ বের হওয়া
  • কানের মধ্যে বাইরে থেকে কিছু একটা ঢুকে আটকে গেলে।

 

References

Goldman, R. (2018, september 20). 11 Effective Earache Remedies. From Healthline: https://www.healthline.com/health/11-effective-earache-remedies

Villines, Z. (2021, 02 25). How do I treat an earache at home? From Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/318057#_noHeaderPrefixedContent

 

 

 

 

 

 

Last Updated on April 16, 2023