নারীদের খুব কমন একটি সমস্যা হলো পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) যা মূলত হরমোনজনিত একটি রোগ। নারীদের শরীরে পুরুষ হরমোনের (Androgen) মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকার ফলে এই রোগ হয়ে থাকে।
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে ওভারিতে অনেকগুলো সিস্ট দেখা যায়। এছাড়াও এই রোগের ক্ষেত্রে আরো যেসব লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় তা হলোঃ
- ব্রণ হওয়ার প্রবণতা
- ত্বকে অবাঞ্ছিত লোম গজানো
- অনিয়মিত পিরিয়ড হওয়া
- শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া
- চুল পড়ে যাওয়া
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম নিরাময়ের ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও জীবন যাপন পদ্ধতির পরিবর্তন উপকারী ভূমিকা পালন করে। এই অনুচ্ছেদে এমন ১৫টি প্রাকৃতিক উপায় বর্ণনা করা হয়েছে যা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম সারাতে সাহায্য করবে।
Table of Contents
খাদ্য পরিবর্তন
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের লক্ষণ নিরাময়ের ক্ষেত্রে খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেসব খাবার খাওয়া উপকারী হবে সেগুলো বেশি বেশি খেতে হবে আর যেগুলো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে সেগুলো যতটা সম্ভব বর্জন করার চেষ্টা করতে হবে। (Watson, 2023)
১। আঁশযুক্ত শর্করা
সরল শর্করা জাতীয় খাবার (চিনি, ময়দার তৈরি খাবার, ভাত ইত্যাদি) কম খেতে হবে। কারণ এই জাতীয় খাবারগুলো শরীরের ওজন ও রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ রয়েছে এমন খাবার খেতে হবে। যেমনঃ বাদামী চালের ভাত, লাল আটার রুটি, ওটস, যব ইত্যাদি।
একবারে বেশি পরিমাণে খাবার খাওয়া যাবে না। বরং দিনের মধ্যে ৪ থেকে ৫ বার অল্প পরিমাণ খাবার খেতে হবে। কখনো কোনো বেলার খাবার বাদ দেওয়া যাবে না।
২। ভালো মানের প্রোটিন
দৈনিক ক্যালরি চাহিদার ১০ শতাংশ প্রোটিন জাতীয় খাবার থেকে গ্রহণ করতে হবে। তবে অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত প্রোটিন (দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, গরুর মাংস, মুরগির চামড়া ইত্যাদি) খাওয়া যাবে না। ডিম, মুরগির মাংস, মাছ, ফ্যাট ফ্রি দুধ ইত্যাদি খেতে হবে।
৩। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের লক্ষণ নিরাময়ে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মাছ হলো ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের সবচেয়ে ভালো একটি উৎস। মাছ ছাড়াও ডিম, দুধ, বাদাম, তিসি, সয়াবিন, কালোজিরা ও চিয়া সীড থেকে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়।
৪। এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার
এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের লক্ষণ নিরাময়ে সাহায্য করে। ফলমূল ও শাকসবজি থেকে প্রচুর পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট পাওয়া যায়।
প্রতিদনের খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি রাখতে হবে। রান্না না করে বরং সালাদ হিসেবে সবজি খেতে পারলে সবচেয়ে বেশি উপকারিতা পাওয়া যায়। কারণ তাপের ফলে এন্টি-অক্সিডেন্ট কমে যায়।
৫। আয়রন ও ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার
পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে শরীরে আয়রনের অভাব জনিত রক্তস্বল্পতা হতে পারে। তাই আয়রন সমৃদ্ধ খাবারগুলো বেশি বেশি খেতে হবে। যেমনঃ ডিম, মাছ, মুরগির মাংস, ডাল, পালংশাক, বাদাম, মটরশুটি, শিমের বিচি, কচু শাক ইত্যাদি খেতে হবে।
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের রোগীদের ক্ষেত্রে পিরিয়ডের সময় তীব্র ব্যথা হয় যা কমাতে ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উপকারী হবে। কুমড়ার বিচি, বাদাম, চিয়া সীড, পালংশাক, সয়া দুধ, অ্যাভোকাডো, কলা, পেঁপে, ডার্ক চকোলেট ইত্যাদি হলো ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার।
৬। ক্যাফেইন
অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণের ফলে শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে যা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের লক্ষণ বাড়িয়ে দিতে পারে। কফিতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ক্যাফেইন থাকে আর তাই কফি খাওয়ার অভ্যাস কমাতে হবে।
গ্রিন টি হলো সবচেয়ে কম ক্যাফেইন সমৃদ্ধ এবং প্রচুর পরিমাণ এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। তাই কফির পরিবর্তে চিনি ছাড়া গ্রিন টি পান করার অভ্যাস করতে হবে।
আরোও কিছু খাবার আছে যা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম সারাতে কাজে দিতে পারে।
সাপ্লিমেন্ট
কতগুলো ভিটামিন ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে।
৭। ভিটামিন ডি
শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতির সাথে পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। তাই ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণের জন্য মাঝেমধ্যে রোদ পোহাতে হবে। সূর্যের তাপ সরাসরি ত্বকে লাগলে শরীরে ভিটামিন ডি উৎপাদন হয়।
অতিরিক্ত ঘাটতি পূরণের জন্য ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে। ভিটামিন ডি ক্যাপসুল, ট্যাবলেট ও ইনজেকশন আকারে কিনতে পাওয়া যায় যা সেবনের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
৮। জিংক
জিংক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উপকারী হবে। চর্বিহীন মাংস, ফ্যাট ফ্রি দুধ, ডিম, ডাল, ছোলা, মটরশুটি, বাদাম, আলু, শাকসবজি ইত্যাদি খাবারে জিংক রয়েছে। এছাড়াও জিংক সাপ্লিমেন্ট কিনতে পাওয়া যায় যা সেবনের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
৯। ক্যালসিয়াম
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের ক্ষেত্রে ওভারি থেকে ডিম্ব নিঃসরণ ব্যাহত হয় এবং পিরিয়ডের সময় তীব্র পেট ব্যথা হয়ে থাকে। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার (দুধ, বাদাম, ব্রকলি, বাঁধাকপি, সয়াবিন ও মাছ) বা সাপ্লিমেন্ট খাওয়া ওভারি থেকে ডিম্ব নিঃসরণ হতে এবং পিরিয়ডের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট কিনতে যা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করা উচিত।
ভেষজ
ভেষজ উপাদানগুলো প্রাকৃতিকভাবে ওষুধি গুণাগুণ সম্পন্ন হয়ে থাকে এবং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
১০। হলুদ
হলুদে থাকা কারকিউমিনের (Curcumin) প্রদাহ নাশক গুণাবলী পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের লক্ষণাবলী নিরাময়ের ক্ষেত্রে সাহায্য করে। রান্নার কাজে হলুদ ব্যবহার করা ছাড়াও প্রতিদিন সকালে এক চা চামচ হলুদের গুঁড়া এক গ্লাস পানিতে গুলিয়ে পান করা উপকারী হবে।
১১। প্রোবায়োটিকস
ইয়োগার্ট (Yogurt) হলো প্রোবায়োটিকস সমৃদ্ধ একটি খাবার যা হরমোন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রদাহ কমানোর জন্য পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের রোগীদের ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে। বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির ইয়োগার্ট কিনতে পাওয়া যায় যার মধ্যে সবচেয়ে কম চিনি যুক্ত দেখে ইয়োগার্ট কিনতে হবে।
১২। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের রোগীদের ক্ষেত্রে সাধারণত শরীরের অতিরিক্ত ওজন দেখা যায় যা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী। ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য দৈনিক ক্যালরি চাহিদার চেয়ে কম পরিমাণে খাবার খেতে হবে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হব। (Mayo Clinic, 2022)
১৩। ব্যায়াম
শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ ও হরমোনের মাত্রা ঠিক রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা উপকারী হবে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে পারলে ভালো। যেকোনো ধরনের ব্যায়াম করতে হবে।
১৪। ভালো ঘুম
শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ভালো ঘুম হওয়া জরুরী। প্রতিদিন ৭ থেকে ৯ ঘন্টা ঘুমাতে হবে। ভালো ঘুমের জন্য রাতের খাবার দেরিতে খাওয়া যাবে না এবং সন্ধ্যার পর চা ও কফি না খাওয়া উত্তম।
ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে মোবাইল ব্যবহার করা যাবে না। ঘরের পরিবেশ ও বিছানা ঘুমের জন্য আরামদায়ক হতে হবে।
১৫। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ
অতিরিক্ত মানসিক চাপ শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ইয়োগা ও মেডিটেশন করা উপকারী হবে। এছাড়াও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া উপকারী হতে পারে।
সতর্ক থাকুন
বাজারে অনেক সাপ্লিমেন্ট কিনতে পাওয়া যায় যা চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। কোনো সাপ্লিমেন্ট বা ওষুধ গ্রহণ করার পূর্বে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন। কারণ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা নিরাপদ ও কার্যকরী হবে কিনা সেটা জানা জরুরী।
ডাক্তারের পরামর্শ নিন
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের জটিলতা হিসেবে বন্ধ্যাত্ব ও জরায়ু ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক পদ্ধতির উপর ভরসা না করে বরং গাইনী ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। তবে চিকিৎসার পাশাপাশি রোগ নিরাময়ের জন্য সহায়ক ভূমিকা হিসেবে প্রাকৃতিক পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।
References
Mayo Clinic. (2022, September 08). Polycystic ovary syndrome (PCOS). Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/pcos/diagnosis-treatment/drc-20353443
Watson, K. (2023, 2 06). 30 Natural Ways to Help Treat Polycystic Ovary Syndrome (PCOS). Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/womens-health/natural-treatment-pcos
Last Updated on November 21, 2023
Leave A Comment