মহিলাদের ওভারিতে অনেকগুলো সিস্ট হলে তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) বলা হয় যা হরমোনজনিত একটি রোগ। এই রোগে আক্রান্ত মহিলাদের জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা জরুরী। কারণ রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে খাবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) রোগে আক্রান্ত মহিলাদের জন্য কোন ধরনের খাবার খাওয়া উপকারী হবে আর কোন কোন খাবারগুলো বর্জন করা উচিত সেই সম্পর্কে জানার জন্য অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকুন।
Table of Contents
কিভাবে খাদ্যাভাস PCOS কে প্রভাবিত করে?
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের (PCOS) ক্ষেত্রে শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা হয়ে থাকে। পুরুষ হরমোনের (Androgen) মাত্রা বেড়ে যায় এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স দেখা যায়। এর ফলে গ্লুকোজ মেটাবলিসমে সমস্যা হয় এবং শরীরে চর্বি জমা হতে থাকে তথা শরীরের ওজন বেড়ে যায়। খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ শরীরের ওজন কমাতে এবং হরমোনের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
পিসিওএস (PCOS) ডায়েট চার্ট এ কোন কোন খাবার যোগ করা উচিত?
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের রোগীদের ডায়েটে যেসব খাবার রাখতে হবে তা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো। (Dresden, 2023)
১। লো-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খাবার
গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (Glycaemic index) বলতে খাবার খাওয়ার পর কত দ্রুত রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে সেটা বোঝানো হয়। যে খাবার খেলে রক্তে সুগারের মাত্রা দ্রুত বেড়ে যায় সেগুলোকে হাই-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খাবার বলা হয়।
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের রোগীদের জন্য লো-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। অর্থাৎ যেগুলো রক্তে সুগারের মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয় না। এই জাতীয় খাবারগুলো রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে।
প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ রয়েছে এমন শর্করা জাতীয় খাবারগুলো লো-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। যেমনঃ বাদামী চালের ভাত, লাল আটার রুটি, যব, ওটস ইত্যাদি।
ফলমূল ও শাকসবজির ক্ষেত্রে সাধারণত গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম দেখা যায়। তবে খুব বেশি মিষ্টি স্বাদের ফলের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি যেগুলো পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। যেমনঃ পাকা আম, কাঠাল, তরমুজ, খেজুর, কিসমিস, কলা ইত্যাদি।
২। প্রদাহ নাশক খাবার
প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে এমন খাবার খাওয়া পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের রোগীদের জন্য উপকারী হবে। ফলমূল, শাকসবজি, বাদাম, অলিভ অয়েল ইত্যাদি হলো এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার যা প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে রাখতে হবে।
ফলমূল জুস বানিয়ে না খেয়ে বরং সরাসরি খেতে পারলে বেশি ভালো। আর বাদামের ক্ষেত্রে নিয়ম হলো প্রতিদিন যেকোনো একধরনের বাদাম একমুঠো পরিমাণ খেতে হবে। ভাঁজা বাদামের তুলনায় কাঁচা বাদামে এন্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি থাকে।
সবজি কম তাপে রান্না করতে হবে। কারণ তাপে এন্টি-অক্সিডেন্ট এর পরিমাণ কমে যায়। টমেটো, শশা, গাজর, কাঁচা পেঁপে, লেটুস ইত্যাদি সালাদ হিসেবে খাওয়া যেতে পারে।
৩। ভালো মানের প্রোটিন
প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়া রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে। যেসব প্রোটিন জাতীয় খাবার কম চর্বিযুক্ত সেগুলো খেতে হবে। যেমনঃ ডিম, মুরগির মাংস, মাছ, লো ফ্যাট বা ফ্যাট ফ্রি দুধ, ডাল, ছোলা, মটরশুটি, বাদাম ইত্যাদি।
পিসিওস এর জন্য উপকারী অন্যান্য খাবার সমূহ
পিসিওস রোগীদের জন্য উপকারী খাবার ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কিত আরো কিছু টিপস হলোঃ
- খাদ্য তালিকায় ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ উৎকৃষ্ট একটি খাবার হলো মাছ। এছাড়াও ডিম, দুধ, বাদাম, তিসি, কালোজিরা, চিয়া সীড, সয়াবিন ইত্যাদি থেকেও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়।
- পিরিয়ডের সময় বেশি পরিমাণে রক্তক্ষরণ হলে শরীরে আয়রনের অভাব হতে পারে যা রক্তস্বল্পতা সৃষ্টি করে। আয়রন সমৃদ্ধ খাবার (যেমনঃ ডিম, মাছ, মুরগির মাংস, ডাল, পালংশাক, বাদাম, মটরশুটি, শিমের বিচি, কচু শাক ইত্যাদি) খেতে হবে।
- ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার (দুধ, কুমড়ার বিচি, বাদাম, চিয়া সীড, পালংশাক, অ্যাভোকাডো, পেঁপে, ডার্ক চকোলেট ইত্যাদি) পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের রোগীদের ক্ষেত্রে উপকারী হবে।
- গ্রিন টি পান করা উপকারী হবে। কারণ এতে প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে। দিনে ২ থেকে ৩ কাপ গ্রিন টি (চিনি ছাড়া) পান করতে হবে।
- প্রোবায়োটিকস (ইয়োগার্ট) সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে যা হরমোন নিয়ন্ত্রণ ও প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
- ডার্ক চকোলেট খাওয়া উপকারী হতে পারে। তবে একদিনেই বেশি পরিমাণে খাওয়া যাবে না।
পিসিওএস (PCOS) ডায়েটে কোন কোন খাবারগুলি সীমিত বা এড়ানো উচিত?
- সরল শর্করা জাতীয় খাবার বা হাই-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খাবার (ভাত, ময়দার তৈরি রুটি, বিস্কুট, কেক, চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার) যতটা সম্ভব কম খেতে হবে। (Whelan, 2022)
- কোমল পানীয় পান করা যাবে না। কারণ এতে প্রচুর চিনি থাকে। কোমল পানীয় পান করার ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে।
- ফাস্টফুড বর্জন করতে হবে।
অন্যান্য জীবনধারা পরিবর্তন
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের রোগীদের শরীরের প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট জমা থাকে যা হরমোনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টির জন্য দায়ী। ফ্যাট কমানোর জন্য সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো ব্যায়াম করা। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। হাঁটাহাঁটি, সাইক্লিং, সাঁতার ও ইয়োগা সহ যেকোনো ধরনের ব্যায়াম করা উপকারী হবে।
এছাড়াও অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রতিদিন ৭ থেকে ৯ ঘন্টা ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। ভালো ঘুমের জন্য ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার (বিশেষ করে কফি) খাওয়ার অভ্যাস বাদ দিতে পারলে ভালো। আরও অনেক ঘরোয়া উপায় আছে যা অবলম্বন করলে, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম সারানো সম্ভব।
ভিটামিন ডি পাওয়ার জন্য রোদের তাপ সরাসরি ত্বকে লাগাতে হবে। সূর্যরশ্মি ত্বকে লাগলে শরীরে ভিটামিন ডি উৎপাদন হয়। প্রতিদিন ১০ থেকে ৩০ মিনিট (সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন) রোদ পোহাতে হবে। রোদ পোহানোর সময় শরীর যতটা সম্ভব অনাবৃত রাখতে হবে এবং ত্বকে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা যাবে না।
ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার ও সাপ্লিমেন্ট সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
শেষ কথা
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম দীর্ঘমেয়াদী একটি রোগ যা সম্পূর্ণ নির্মূল করা যায় না। খাদ্যাভ্যাস ও সঠিক জীবন যাপন পদ্ধতি অনুসরণ করার মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। তাই খাবার গ্রহণ সম্পর্কিত নির্দেশনাগুলো অল্পকিছু দিনের জন্য নয়, বরং দীর্ঘদিন মেনে চলতে হবে।
ব্যক্তিভেদে ডায়েট চার্ট ভিন্নতর হয়ে থাকে। শরীরের ওজন, বয়স ও রোগের তীব্রতা বিবেচনায় ডায়েট কেমন হবে সেই সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে একজন পুষ্টিবিদের (Dietitian) পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
References
Dresden, D. (2023, May 31). What to eat if you have PCOS. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/323002
Whelan, C. (2022, March 17). Can Your Diet Relieve Symptoms of Polycystic Ovary Syndrome (PCOS)? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/pcos-diet
Last Updated on November 21, 2023
Leave A Comment