হাঁপানির ইংরেজিতে প্রতিশব্দ অ্যাজমা যা ফুসফুসের প্রদাহজনিত দীর্ঘমেয়াদী একটি রোগ। যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে অ্যাজমা হতে পারে। অ্যাজমায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে শ্বাস গ্রহণের সময় ফুসফুসের সুক্ষ্ম বায়ু নালী (Bronchioles) সঠিকভাবে প্রসারিত হয় না বলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তথা অ্যাজমার লক্ষণ দেখা যায়।
অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগের নির্দেশক লক্ষণ হলো শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, বুকের মধ্যে সাঁই সাঁই শব্দ হওয়া, শুকনো কাশি (বিশেষ করে রাতের বেলায় কাশি বেশি হয়), বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভব করা ইত্যাদি।
চিকিৎসার মাধ্যমে হাঁপানি একদম ভালো হয়ে যায় না। তবে রোগ লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। হাঁপানি রোগের চিকিৎসা হলো মুখে ওষুধ সেবন অথবা ইনহেলার ব্যবহার করা। এছাড়াও কতিপয় ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করা হাঁপানি নিরাময়ের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে যা এই অনুচ্ছেদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু।
Table of Contents
হাঁপানি রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা
হাঁপানি রোগের ক্ষেত্রে ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ সেবন না করে শুধুমাত্র ঘরোয়া পদ্ধতির উপর ভরসা করা যাবে না। নিচে হাঁপানি রোগের ১০টি ঘরোয়া চিকিৎসা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো। (Wilson, 2023)
১. বিটা ক্যারোটিন
হাঁপানি রোগীদের ক্ষেত্রে সুক্ষ্ম বায়ু নালীতে প্রদাহের ফলে শ্বাস গ্রহণের সময় বায়ু চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবারের এন্টি অক্সিডেন্ট (Antioxidant) গুণাবলী প্রদাহ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
গাজর, মিষ্টি কুমড়া, আম, পাকা পেঁপে, মিষ্টি আলু, তরমুজ, ব্রকলি, বাঁধাকপি, মটরশুটি, লেটুসপাতা, পালংশাক ইত্যাদি হলো বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার যা হাঁপানি রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধে সাহায্য করে।
২. ভিটামিন সি
ভিটামিন সি ফুসফুসের সুক্ষ্ম বায়ু নালীর প্রদাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হাঁপানি প্রতিকারে সাহায্য করে। লেবু, কমলা, মাল্টা, আঙ্গুর, আমলকী, বরই, পেঁপে, আনারস, জাম, কাঁচা মরিচ, পুদিনাপাতা, টমেটো ইত্যাদি হলো ভিটামিন সি জাতীয় খাবার। ভিটামিন সি প্রাকৃতিক এন্টিহিস্টামিন হিসেবে কাজ করে অর্থাৎ এলার্জি জনিত হাঁপানি রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩. ভিটামিন ডি
শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব অ্যাজমার লক্ষণ বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি পেতে মাঝে মধ্যে সূর্যের তাপ গায়ে লাগাতে হবে। রোদ পোহানোর সময় শরীর যতটা সম্ভব অনাবৃত রাখতে হবে এবং সানস্ক্রিন ব্যবহার করা যাবে না। এছাড়াও ডিমের কুসুম, দুধ, পনির, মাছ, মাশরুম ইত্যাদি খাবার থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।
৪. ভিটামিন ই
ভিটামিন ই এর এন্টি অক্সিডেন্ট গুণাবলী রয়েছে যা ফুসফুসের বায়ু নালীর প্রদাহ দূর করার মাধ্যমে হাঁপানি নিরাময়ে সাহায্য করে। ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার হলো অলিভ অয়েল, সূর্যমুখী তেল, সয়াবিন তেল, বাদাম, পাকা আম, অ্যাভোকাডো, মিষ্টি কুমড়া, টমেটো, পালংশাক, ব্রকলি, ডিম ইত্যাদি।
৫. ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে এবং ফুসফুস ভালো রাখতে সাহায্য করে। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের সবচেয়ে ভালো একটি উৎস হলো মাছ। নিয়মিত মাছ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এছাড়াও তিসি, বাদাম, সয়াবিন, কালোজিরা, চিয়া সীড, শিমের বিচি, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি থেকে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়।
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের অসাধারণ ১৫ টি স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
৬. ক্যাফেইন
চা ও কফি হলো ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার যা প্রায় সবার কাছেই বেশ জনপ্রিয় পানীয়। ক্যাফেইন Bronchodilator হিসেবে কাজ করে অর্থাৎ ফুসফুসের সুক্ষ্ম বায়ু নালী (Bronchioles) সঠিকভাবে প্রসারিত হতে সাহায্য করে।
চা ও কফিতে চিনি মেশানো স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এছাড়াও যাদের ঘুমের সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য সন্ধ্যার পরে চা ও কফি পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৭. আদা
রান্নার কাজে আদার ব্যবহার খাবারের স্বাদ ও গন্ধ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তবে আদার উপকারিতা শুধু এতটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং আদাতে বিদ্যমান Gingerol উপাদানটির প্রদাহ নাশক গুণাবলী রয়েছে যা হাঁপানির লক্ষণ নিরাময়ে সাহায্য করে।
সামান্য পরিমাণে কাঁচা আদা সরাসরি মুখে চিবিয়ে খাওয়া অথবা চায়ের সাথে আদা যোগ করা যেতে পারে।
৮. রসুন
রসুনের প্রদাহ নাশক গুণাবলী রয়েছে এবং রক্তের ইসোনফিলের (Iosinophils) মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে যা হাঁপানি নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রান্নার কাজে রসুন ব্যবহার করা ছাড়াও প্রতিদিন এক কোয়া কাঁচা রসুন সরাসরি খাওয়া উপকারী হবে।
৯. মধু
অ্যাজমার লক্ষণ (বিশেষ করে কাশি) দূর করতে মধুর উপকারী ভূমিকা রয়েছে। প্রতিদিন এক টেবিল চামচ মধু খাওয়া যেতে পারে। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে মধু খেতে হবে। কারণ মধু রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। মধু খাওয়ার দারুন একটি উপায় হলো চা অথবা কফির সাথে যোগ করে পান করা।
১০. ইয়োগা ও মেডিটেশন
ইয়োগা ও মেডিটেশনের অনেকগুলো স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে যার মধ্যে অন্যতম হলো মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করা। অতিরিক্ত মানসিক চাপ অ্যাজমার লক্ষণ বাড়িয়ে দেয়। আর তাই অ্যাজমা রোগীদের জন্য ইয়োগা ও মেডিটেশন বেশ উপকারী হতে পারে।
ঘরোয়া উপায়ের পাশাপাশি, হাপানি রোগ নিয়ন্ত্রণে কিছু সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ অনেকটা উপকারি হতে পারে।
হাঁপানির জন্য করণীয় বিষয়াবলী
- এলার্জিক খাবার খাওয়া যাবে না।
- ঘরের বাইরে গেলে ধুলাবালি ও ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য মাস্ক পরিধান করতে হবে।
- এলার্জিক বস্তুর (পরাগরেণু, পোষা প্রাণীর লোম ও কার্পেটের ময়লা) সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে।
- মানসিক চাপ কমাতে হবে।
- ধুমপান করা যাবে না।
মানসিক চাপ কিভাবে কমানো যায় সেই সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
হাঁপানি রোগ প্রতিরোধ
হাঁপানি রোগের প্রকৃত কারণ অজানা। তাই এই রোগ প্রতিরোধের শতভাগ কার্যকরী কোনো পদ্ধতি নেই। তবে যেসব বিষয়কে এই রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী মনে করা হয় সেগুলো বর্জন করা সহ কতিপয় নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব। যেমনঃ (Goodwin, 2021)
- ধুমপায়ী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে। আর তাই ধুমপানের অভ্যাস থাকলে বর্জন করতে হবে।
- শরীরের অতিরিক্ত ওজন হাঁপানি রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পরিমিত খাবার গ্রহণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
- শিশুদের জন্য সঠিক সময়ে টিকা (Vaccine) গ্রহণ করতে হবে।
- শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো রাখার জন্য পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর ১৪ টি টিপস জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
হাঁপানি কোনো ছোঁয়াচে প্রকৃতির রোগ নয় অর্থাৎ হাঁপানিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে না। তাই অসুস্থ ব্যক্তি থেকে দূরে থাকার প্রয়োজন নেই। বরং সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য করণীয় হলো অসুস্থ ব্যক্তির পাশে থেকে তাকে সেবা শুশ্রূষা করা।
References
Goodwin, M. (2021, October 27). Asthma: Symptoms, Treatment, and Prevention. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/asthma
Wilson, D. R. (2023, May 10). 14 Natural Ways to Help Treat Severe Asthma. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/severe-asthma/natural-remedies
Last Updated on November 11, 2023
Leave A Comment