৬০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে প্রতি ৫ জনে ১ জন এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জনের পিত্তথলিতে পাথর হতে দেখা যায়। অর্থাৎ অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই এই স্বাস্থ্য সমস্যাটি হয়ে থাকে কিন্তু এই রোগের প্রাথমিক অবস্থায় তেমন কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় না। আর তাই এই রোগের ব্যাপারে সাধারণ মানুষদের মধ্যে তেমন কোনো উদ্বেগ দেখা যায় না। (Harvard Medical School, 2014)

তবে এই রোগটির ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা জরুরি বিশেষত কেনো মহিলাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে তা পাঠকের মনে নিশ্চই কৌতুহল সৃষ্টি করেছে। এই অনুচ্ছেদ পাঠের মাধ্যমে আপনার কৌতুহল মেটানো সহ পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার কারণ, রিস্ক ফ্যাক্টর, লক্ষণ, জটিলতা, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায় সমূহ জানতে সক্ষম হবেন। সেই সাথে এই অনুচ্ছেদের শেষের দিকে রয়েছে পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সহায়তাকারী খাদ্য তালিকা।

পিত্তথলিতে পাথর (gallstone) বলতে কি বুঝায়? (What is Gallstone?)

প্রথমেই পিত্তথলির অবস্থান ও কার্যাবলী সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। পিত্তথলি (Gallbladder) মানুষের শরীরের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অঙ্গ যার অবস্থান পেটের ডানদিকে যকৃতের (Liver) ঠিক নিচে। যকৃত থেকে উৎপন্ন হওয়া পিত্তরস (Bile) পিত্তথলিতে এসে জমা হয় যা পরবর্তীতে অন্ত্রে (Duodenum) প্রবেশ করে  খাদ্য হজমে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

পিত্তরসের মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণে কোলেস্টেরল বা বিলিরুবিনের উপস্থিতি পিত্তথলিতে কঠিন প্রকৃতির তলানি সৃষ্টি করে থাকে যাকে পিত্তথলির পাথর অথবা Gallstones বলা হয়। পিত্তথলিতে বালুকণার মতো ছোট আকারের পাথর হতে পারে আবার মটর দানার মতো বড়ো মাপের পাথরও হতে পারে। তেমনিভাবে পাথর সংখ্যায় এক অথবা একাধিক হতে দেখা যায়।

উল্লেখ্য পিত্তথলিতে পাথর হলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় Cholelithiasis বলা হয়ে থাকে। তবে পাথর যদি পিত্তথলিতে না হয়ে পিত্তনালিতে হয় তখন তাকে Choledocholithiasis বলা হয়।

পিত্তথলির পাথরের কারণ কি?

পিত্তরসের (Bile) মধ্যে রাসায়নিক উপাদানের ভারসাম্যহীনতার ফলে পিত্তথলিতে পাথর হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তিনটি বিষয়কে দায়ী মনে করে থাকেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা যা নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো। (DiGiacinto, 2021)

  • লিভারে (Liver) পিত্তরস তৈরি হওয়ার পরে তা পিত্তথলিতে এসে জমা হয় এবং পিত্তরসের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে পিত্তথলি থেকে পিত্তরস বেড়িয়ে অন্ত্রে প্রবেশ করে । তখন পিত্তথলি প্রায় খালি হয়ে যায়। লিভার থেকে বেশি পরিমাণে পিত্তরস নিঃসরণ অথবা পিত্তথলি থেকে পিত্তরস বেড়িয়ে যাওয়ার পরিমাণ কমে যাওয়ার দরুন পিত্তথলিতে অতিরিক্ত পরিমাণে পিত্তরস জমা হয় এবং সেই সাথে অধিক হারে পিত্তরসের ঘনত্ব বেড়ে যায় যা পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার অন্যতম প্রধান একটি কারণ ।
  • লিভার থেকে নিঃসৃত কোলেস্টেরল দ্রবীভূত করার জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদান পিত্তরসের মধ্যে উপস্থিত থাকে। কিন্তু লিভার থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে কোলেস্টেরল নিঃসৃত হলে তখন তা পিত্তথলিতে হলুদ বর্ণের কোলেস্টেরল পাথর সৃষ্টি করে থাকে।
  • লোহিত রক্ত কণিকা একটি নির্দিষ্ট সময় পরে লিভারের মধ্যে ভেঙ্গে পড়ে এবং বিলিরুবিন হিসেবে পিত্তথলিতে এসে পিত্তরসে দ্রবীভূত হয়। লিভারের গোলযোগ অথবা রক্তের সমস্যার দরুন অধিক হারে লোহিত রক্ত কণিকার ভেঙ্গে পড়া বা লিভার থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে বিলিরুবিন নিঃসরণের ফলে পিত্তথলিতে গাঢ় বাদামী বা কালো বর্ণের পাথর সৃষ্টি হয়।

Gallstone এর রিস্ক ফেক্টরগুলো কি কি?

বয়স, জীবন যাপন পদ্ধতি, খাদ্যাভ্যাস, বিশেষ কিছু ওষুধ সেবন, রোগ ইত্যাদির সাথে পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে যাকে মেডিকেলের ভাষায় রিস্ক ফ্যাক্টর (Risks factors) বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। পিত্তথলিতে পাথর বা Gallstones এর রিস্ক ফ্যাক্টর গুলো হলোঃ

  • অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা
  • অলস ও কর্মবিমুখ জীবন যাপন
  • ৬০ বছরের বেশি বয়স
  • পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার পারিবারিক ইতিহাস
  • চর্বি জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া
  • আঁশযুক্ত (Fiber) খাবার কম খাওয়া
  • টাইপ-২ ডায়াবেটিস
  • লিভার সিরোসিস (Cirrhosis of liver)
  • কোলেস্টেরলের ওষুধ সেবন

এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ (NIH of US) এর তথ্য অনুযায়ী দ্রুত শরীরের ওজন কমানো হলে তা লিভার ও পিত্তথলির উপর অতিরিক্ত চাপের সৃষ্টি করে যা পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। (Johnson, 2020)

মহিলাদের ক্ষেত্রে কেন পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা বেশি?

মহিলাদের বেলায় পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা বেশি হওয়ার কারণ হলো জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওষুধ (Oral contraceptive pill) সেবন, গর্ভধারণ করা, মেনোপজের (Menopause) পর হরমোন থেরাপি নেওয়া ইত্যাদি। (Harvard Medical School, 2014)

এসব ক্ষেত্রে শরীরে ইস্ট্রোজেন (Estrogen) হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং প্রজেস্টেরন (Progesterone) হরমোনের পরিমাণ কমে যায়। আর ইস্ট্রোজেন বেড়ে যাওয়ার ফলে পিত্তরসে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং সেই সাথে প্রজেস্টেরনের অভাবে পিত্তথলি খালি (Empty) হতে পারে না (অর্থাৎ পিত্তথলীর নিয়মিত কার্যাবলীতে ব্যাঘাত ঘটে) যা পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার অন্যতম কারণ।

পিত্তথলির পাথরের লক্ষণ ও উপসর্গ কি?

পিত্তথলির পাথরের লক্ষণ ও উপসর্গ

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পিত্তথলিতে পাথর হলে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। বিশেষত ক্ষুদ্র আকারের পাথর যা পিত্তথলির একদম নিচে পড়ে থাকে এমন ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ বা সমস্যার সৃষ্টি হয় না। তবে পাথরের আকার বড় হলে বা পাথরের অবস্থান পিত্তথলির মুখে (Cystic ducts) অথবা পিত্তনালিতে হলে সেক্ষেত্রে নিম্নলিখিত উপসর্গগুলো দেখা দেয়। যেমনঃ

  • বমি বমি ভাব ও বমি (Nausea & vomiting)
  • পেটের ডানদিকে হঠাৎ করে তীব্র ব্যথা হয় যা কয়েক মিনিট থেকে সর্বোচ্চ কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে
  • ডান কাঁধে ব্যথা হয় এবং ব্যথা সারা পিঠে ছড়িয়ে পড়তে পারে
  • চোখ,‌ মুখমণ্ডল ও ত্বকের রং হলুদ বর্ণের হয়ে যাওয়া (Jaundice)
  • ক্ষুধা কমে যায়
  • জ্বর ও প্রচন্ড শীত বোধ
  • ডায়রিয়া (Diarrhea)
  • প্রস্রাবে তলানি

উপরে উল্লেখিত লক্ষণ সমূহ পিত্তথলিতে পাথর ছাড়াও অন্যান্য রোগের (যেমন: লিভার, পিত্তথলি ও প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ) ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে। আর তাই লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে যে পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে কিনা।

Gallstone কিভাবে ডায়াগনোসিস করা হয়?

How Gallstone is Diagnosed

পিত্তথলির পাথর বা Gallstones ডায়াগনোসিস এর জন্য নিম্নোক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়ে থাকে।

রক্ত পরীক্ষা (Blood Tests): নমুনা হিসেবে রক্ত সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে ESR (erythrocyte sedimentation rate) ও বিলিরুবিনের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। বিলিরুবিন ও ESR এর মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী হলে তা পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার সংকেত প্রদান করে।

এক্সরে ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি (Chest x-ray & USG of whole abdomen): পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায় পেটের এক্সরে ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা করানোর মাধ্যমে। এক্সরে ফিল্ম (X-ray film) ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট দেখে পিত্তথলির পাথরের আকার ও অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

সিটি স্ক্যান (CT scan): পিত্তথলির পাথরের সাথে সাথে লিভারের কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করার জন্য অনেক সময় চিকিৎসকেরা পেটের সিটি স্ক্যান (Abdominal CT scan) করানোর নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।

Gallstone এর চিকিৎসা

পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার ফলে কোনো লক্ষণ বা জটিলতা না দেখা গেলে বিশেষ কোনো চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ একদম ক্ষুদ্র আকৃতির পাথর অনেক সময় আপনাআপনি পিত্তরসের সাথে অন্ত্র ও পায়ুপথের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।

দীর্ঘদিন ধরে পিত্তথলিতে পাথর থাকলে তা মাঝে মধ্যে ব্যথা সহ নানাবিধ লক্ষণ এবং পরবর্তীতে জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে আর তাই সার্জারির মাধ্যমে পিত্তথলি অপসারণ করে ফেলাই সবচেয়ে ভালো। তবে পিত্তথলিতে পাথরের চিকিৎসায় সার্জারি ছাড়াও আরো কিছু পদ্ধতি রয়েছে। যেমনঃ

মুখে ওষুধ সেবন:

কতিপয় ওষুধ রয়েছে যা পিত্তথলির পাথর ভেঙ্গে ছোট করে ফেলতে বা পাথর দ্রবীভূত করতে পারে। এমন ওষুধের মধ্যে অন্যতম হলো

  • Ursodiol (Actigall)
  • Chenodiol (Chenix)

মুখে ওষুধ সেবনের মাধ্যমে পিত্তথলির পাথরের চিকিৎসা নিরাপদ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ামুক্ত। তবে এক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা রয়েছে । যেমনঃ

  • দীর্ঘদিন যাবত ওষুধ সেবন করতে হয়
  • শুধুমাত্র কোলেস্টেরল পাথরের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে
  • গর্ভবতী মহিলা ও শিশুকে বুকের দুধ পান করান এমন মায়েদের জন্য এই ওষুধগুলো প্রযোজ্য নয়
  • এছাড়াও সাধারণ মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ওষুধ সেবনের সময় জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওষুধ সেবন করা যায় না

 

Shock wave lithotripsy:

এটি এমন একধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে ওষুধ ও সার্জারি ছাড়াই শরীরের বাইরে থেকে বিশেষ এক ধরনের তরঙ্গ প্রেরণের মাধ্যমে পিত্তথলির পাথর ভেঙ্গে ছোট করে ফেলা হয়। অতঃপর তা (ক্ষুদ্র পাথর) আপনাআপনি শরীর থেকে বের হয়ে যায়।

এই পদ্ধতির চিকিৎসা পিত্তথলির পাথর ও কিডনির পাথর ভেঙ্গে ফেলার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এর সীমাবদ্ধতা হলো পাথরের আকার ২ সেন্টিমিটার (2 cm) এর বেশি হলে সেক্ষেত্রে এই চিকিৎসা পদ্ধতি কার্যকরী হয় না।

ERCP:

Endoscopic retrograde cholangiopancreatography কে সংক্ষেপে ERCP বলা হয়। পিত্তনালিতে পাথর হলে তা অপসারণের জন্য এই পদ্ধতিটি বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। এটি একটি নিরাপদ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি তবে এর সীমাবদ্ধতা হলো এক্ষেত্রে পিত্তথলির পাথর অপসারণ করা যায় না।

পিত্তথলির পাথরের চিকিৎসা হিসেবে সার্জারির মাধ্যমে সরাসরি পিত্তথলি (Gallbladder) অপসারণ করা হলে তা একই সাথে পাথর এবং পরবর্তীতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা দূর করে। এক্ষেত্রে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে যে পিত্তথলি ফেলে দিলে কোনো ক্ষতি হবে কি? এই ব্যাপারে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে তবে তার আগে জেনে নেওয়া যাক সার্জারির মাধ্যমে পিত্তথলি অপসারণের পদ্ধতি সম্পর্কে।

ওপেন সার্জারি (Open cholecystectomy):

সার্জারির মাধ্যমে পিত্তথলি অপসারণ করা হলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় Cholecystectomy বলা হয়।‌ ওপেন সার্জারির‌ বেলায় সরাসরি পেট কেটে পিত্তথলি অপসারণ করা হয়। এক্ষেত্রে রোগীকে ২ থেকে ৩ দিন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকার প্রয়োজন পড়ে। এই পদ্ধতির সার্জারির অসুবিধা হলো অধিক রক্তপাত ও ইনফেকশনের সম্ভাবনা রয়েছে।

ল্যাপরোস্কপিক সার্জারি (Laparoscopic cholecystectomy):

এটি অত্যাধুনিক পদ্ধতির সার্জারি যেখানে পেট না কেটে ৩ থেকে ৪ টি ছিদ্র করা হয়। অতঃপর বিশেষ একধরনের যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ফুটা দিয়ে পিত্তথলি কেটে বের করে আনা হয়। এটি একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা পদ্ধতি তবে এতে রক্তপাত, ইনফেকশন বা অন্য কোনো ধরনের জটিলতার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। সেই সাথে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকার প্রয়োজন পড়ে না।

পিত্তথলি ফেলে দিলে কি কোন ক্ষতি হয়?

পিত্তথলি মানুষের শরীরের একটি ক্ষুদ্র অঙ্গ যা পিত্তরস জমা রাখতে ও পিত্তরসের ঘনত্ব বৃদ্ধি করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে পিত্তথলিতে পাথর অথবা পিত্তথলির অন্য কোনো রোগের ক্ষেত্রে পিত্তথলি অপসারণ করার প্রয়োজন হলে কোনো প্রকার সংশয় ব্যতীতই তা করা যেতে পারে। কারণ পিত্তথলি অপসারণ করা হলে মানুষের শরীরে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিঘ্ন ঘটে না এবং বিশেষ কোনো সমস্যাও হয় না। 

তবে পিত্তথলি অপসারণ করা হলে সেক্ষেত্রে পিত্তরস লিভারে‌ উৎপন্ন হওয়ার পর সরাসরি অন্ত্রে প্রবেশ করে যা হজম সংক্রান্ত সামান্য কিছু সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। যেমনঃ ডায়রিয়া, ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাদ্য ভালো ভাবে হজম না‌ হওয়া ইত্যাদি। তবে এই সমস্ত সমস্যা গুলো পিত্তথলি অপসারণ করা না হলে সেক্ষেত্রে যে জটিলতার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেই তুলনায় অতি নগণ্য। আর তাছাড়া পিত্তথলি না থাকার দরুন যে সমস্যা হতে পারে তা প্রতিরোধের জন্য রয়েছে সহজ কিছু করণীয় যা নিচে উল্লেখ করা হয়েছে।

  • খাবার শেষে হজম সহায়ক হিসেবে কাঁচা পেঁপে খাওয়া।
  • অধিক পরিমাণে কফি পান করা যাবে না।
  • অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার বর্জন করা।
  • আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণের পরিমাণ বাড়ানো ।

পিত্তথলির পাথরের জটিলতা কি?

পিত্তথলির পাথরের জটিলতা

পিত্তথলির পাথরের যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে তা যে সমস্ত জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে তা হলোঃ

Cholecystitis: পিত্তথলিতে প্রদাহ হতে পারে যাকে মেডিকেলের ভাষায় Cholecystitis বলা হয়। এটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক একটি সমস্যা যার ফলে প্রচন্ড পেটে ব্যথা ও জ্বর হয়ে থাকে।

ইনফেকশন: দীর্ঘদিন ধরে পিত্তথলিতে পাথর থাকলে তা ইনফেকশনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে যা পরবর্তীতে gallbladder abscess এ রূপান্তরিত হয়। আর এমতাবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে সার্জারি করার প্রয়োজন পড়ে।

জন্ডিস: পিত্তনালিতে পাথর হলে তা পিত্তরস চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় যা তীব্র মাত্রার জন্ডিস সৃষ্টি করতে পারে।

পিত্তথলির ক্যান্সার (Gallbladder cancer): দীর্ঘদিন ধরে পিত্তথলিতে পাথর থাকলে তা পিত্তথলির ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

সতর্কতা

আমাদের দেশে গ্রামীণ একটি কুসংস্কার রয়েছে আর তা হলো জন্ডিসের ক্ষেত্রে কবিরাজি চিকিৎসাকে প্রাধান্য দেওয়া। অধিকাংশ সময়েই লিভারের সামান্য প্রদাহ জনিত কারণে জন্ডিস হয়ে থাকে যা কোনো চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যায়। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কবিরাজ গণ জন্ডিস সারিয়ে সাধারণ মানুষকে তাক লাগিয়ে দেন।

কিন্তু লিভারের জটিলতর সমস্যা অথবা পিত্তথলির পাথর জনিত কারণে জন্ডিস হলে সেক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এমতাবস্থায় কবিরাজি চিকিৎসার উপর ভরসা করলে রোগের জটিলতা বেড়ে যায় এবং তা একসময়ে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই যুগে কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি একদম পরিহার করা উচিত।

Gallstone কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?

পিত্তথলিতে পাথর হলে সার্জারির প্রয়োজন হয়ে থাকে। তবে অনেক মানুষ আছে যারা সার্জারির‌ নাম শুনলেই ভয় পেয়ে থাকেন। আর তাছাড়া পিত্তথলির পাথরের যথাযথ চিকিৎসা ‌গ্রহণ করা না হলে সেক্ষেত্রে অধিক জটিলতর সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।

তাই সবচেয়ে সহজ ও নিরাপদ হলো পিত্তথলির পাথর যেনো না হয় সেই ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া। এই পর্যায়ে Gallstones বা পিত্তথলির পাথর কিভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

  • কখনোই কোনো বেলার খাবার বাদ দেওয়া যাবে না। কারণ তাতে পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর তাই প্রতি বেলার খাবার সময় মতো খেয়ে নিতে হবে।
  • শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। এক্ষেত্রে BMI (Body mass index) অনুযায়ী কার শরীরের জন্য কতটুকু ওজন স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচিত হবে তা জেনে নেওয়া উচিত।
  • শরীরের অতিরিক্ত ওজন দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে না। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত নিয়ম হলো সপ্তাহে সর্বোচ্চ ১ কেজি ওজন কমানো ।
  • যে সমস্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে তারা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি খাওয়ার পরিবর্তে অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন।
  • ধুমপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করা জরুরি।
  • প্রত্যেক দিন ৩০ মিনিট করে ব্যায়াম করতে হবে।

Gallstone এর ঝুঁকি কমাতে খাদ্য তালিকায় কি কি পরিবর্তন আনা উচিত?

গবেষণায় দেখা গেছে যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে পিত্তথলির পাথর হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই হ্রাস করা যায়। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণের ব্যাপারে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে। (Johnson, 2020)

  • ফলমূল ও শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে। কারণ এই সমস্ত খাবারের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ ও এন্টি-অক্সিডেন্ট যা পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা কমায়
  • কম পরিমাণে চর্বি রয়েছে এমন আমিষ (Low-fat protein) গ্রহণ করতে হবে। যেমন: মুরগির মাংস, মাছ, বাদাম ইত্যাদি
  • প্রচুর পরিমাণে আঁশ রয়েছে এমন খাবার যেমন আপেল, কলা, গাজর, শিম, ডাল, মটরশুটি, আমড়া, পেয়ারা, সজনে ডাঁটা ইত্যাদি খেতে হবে
  • গবেষণায় দেখা গেছে যে পরিমিত মাত্রায় কফি পান করা হলে তা পিত্তরসের মধ্যে রাসায়নিক উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে কফি পান করা যাবে না। (Johnson, 2020)
  • ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের ফলে পিত্তথলি ভালো থাকে

Gallstone এর খাদ্য তালিকায়

কোন ধরনের খাবারের মধ্যে ক্যালসিয়াম রয়েছে তা জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

  • ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার পিত্তথলির রোগ প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আঙুর, মালটা, লেবু, টমেটো, পেঁপে, স্ট্রবেরি, জলপাই ও পেয়ারার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে

এছাড়াও আরেক গবেষণায় দেখা গেছে যে সরল শর্করা (Refined carbohydrates), অতিরিক্ত আমিষ ও চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহণের ফলে পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। (Johnson, 2020) আর তাই এই সমস্ত খাবার গুলো পরিমিত মাত্রায় খেতে হবে।

এছাড়াও মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, ফাস্টফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার ইত্যাদি খাওয়ার অভ্যাস কমাতে হবে।

কোন খাবারের মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত চর্বি রয়েছে এবং কোন ধরনের চর্বি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

পিত্তথলিতে পাথরের লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি এবং পিত্তথলির পাথর অপসারণের জন্য যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর সুস্থ মানুষদের জন্য পিত্তথলিতে পাথর যেনো না হয় সেই জন্য Gallstones প্রতিরোধের উপায় ও খাদ্য তালিকা মেনে চলতে সচেষ্ট হতে হবে।

 

 

References

DiGiacinto, J. (2021, October 07). A Guide to Gallstones. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/gallstones

Harvard Medical School. (2014, December 12). Gallstones: Symptoms, diagnosis and treatment. Retrieved from Harvard Health Publishing: https://www.health.harvard.edu/digestive-health/gallstones-symptoms-diagnosis-and-treatment

Johnson, J. (2020, January 27). Diet tips for a healthy gallbladder. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/317196

Last Updated on May 6, 2023