তুলনামূলক যারা খাটো বা বেঁটে প্রকৃতির মানুষ তাদের মনে খানিকটা লম্বা হওয়ার অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়। এমনকি লম্বা হওয়ার জন্য নানাবিধ চেষ্টা যেমন- ব্যায়াম করা, ডায়েট পালন, সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ এবং গ্রোথ হরমোন থেরাপি নেওয়া সহ‌ বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বনেও পিছপা হন না অনেকেই। কোন কোন বিষয়গুলো উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত, লম্বা হওয়ার প্রচেষ্টায় আসলে কতটা সার্থক হওয়া সম্ভব এবং কি কি পদ্ধতি অবলম্বন করে উচ্চতা বাড়ানো যায় সেই বিষয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

উচ্চতা বৃদ্ধি না হওয়ার কারণ কি?

চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে, মানুষের শরীরের উচ্চতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জিনগত (Genetic factors) প্রভাব হলো ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ কার উচ্চতা কেমন হবে সেই বিষয়ে মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে জিন যা প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীর বংশগতির মৌলিক আণবিক একক। সন্তান বা উত্তরসূরী তার পিতা মাতার কাছ থেকে জিন পেয়ে থাকে যা বংশগতির ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে। আর তাই মা বাবা বেঁটে হলে সেক্ষেত্রে সন্তান বেঁটে হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। মা‌ বাবার উচ্চতা যোগ করে ২ দিয়ে ভাগ করার পর সেই সংখ্যার সাথে ২.৫ ইঞ্চি যোগ করে ছেলের উচ্চতা এবং ২.৫ ইঞ্চি বিয়োগ করে মেয়ের উচ্চতা কত হবে সেই ব্যাপারে ধারণা করা যেতে পারে। তবে এই‌ হিসাবটি শুধুমাত্র বাচ্চার উচ্চতা সম্পর্কে একটা অনুমান করতে সাহায্য করে যা সবার ক্ষেত্রে সবসময় মিলে যাবে এমনটি নয়।  

অন্য কোন কারণগুলি উচ্চতাকে প্রভাবিত করে?

জিনগত প্রভাব ছাড়াও আরো কিছু বিষয় রয়েছে যা শরীরের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত। যেমনঃ হরমোন, পুষ্টি উপাদান, জীবন যাপন পদ্ধতি, ঘুম, ব্যায়াম ইত্যাদি। এই লিস্টে আরো রয়েছে কয়েকটি রোগের নাম যা শরীরের উচ্চতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেমনঃ বামনতা (Dwarfism), আর্থ্রাইটিস, ডাউন সিন্ড্রম (Down syndrome), সিলিয়াক ডিজিজ, ক্যান্সার এবং যেসব রোগের জন্য দীর্ঘদিন ধরে স্টেরোয়েড জাতীয় ঔষধ খেতে হয়। 

কিভাবে প্রাকৃতিকভাবে উচ্চতা বাড়ানো যায়?

জীনগত প্রভাব এড়ানোর কোনো উপায় এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার করা যায়নি। তবে অন্যান্য যেসব কারণ রয়েছে সেগুলো পরিবর্তন করার মাধ্যমে শরীরের উচ্চতা বাড়ানো যায়। ছেলেদের জন্য ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত উচ্চতা বৃদ্ধি পায় এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সময়সীমা হলো ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত। ১৮ বছর বয়সের পরে উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। শরীরের উচ্চতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এমন কয়েকটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হলোঃ‌ (Fletcher, 2022)

খাদ্য ও পুষ্টি 

শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য প্রথমত যেটি দরকার সেটি হলো খাবার। খাবার থেকে শরীর তার প্রয়োজনীয় শক্তি ও পুষ্টি সংগ্রহ করে থাকে। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা না হলে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আর তাই প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট সহ প্রচুর পরিমাণ ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে।‌ তবে ক্ষতিকর ট্র্যান্স ফ্যাট, চিনি ও সরল শর্করা জাতীয় খাবার থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে। 

ক্যালসিয়াম 

শরীরের উচ্চতা বৃদ্ধি পায় হাড়ের বৃদ্ধি অনুযায়ী আর হাড় গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো ক্যালসিয়াম। আর তাই শরীরের উচ্চতা বাড়াতে চাইলে অনেক বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে এমন খাবার গুলোর দিকে নজর দিতে হবে। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে অন্যতম হলো দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার,‌ ডিম, মাংস, মাছ বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, মসুর ডাল, ছোলা, মটরশুটি, শিমের বিচি, বাদাম, কিসমিস, খেজুর, চিয়া সিড, তিল ইত্যাদি। 

ভিটামিন ডি

শুধু ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার খেলেই কাজ হবে না কারণ শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য ভিটামিন ডি এর প্রয়োজন হয়। ভিটামিন ডি পাওয়ার সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী উপায় হলো রোদ পোহানো। সূর্যের তাপ ত্বকে লাগলে শরীরে ভিটামিন ডি উৎপাদন হয়।‌ এই জন্যই নিয়মিত কিছুক্ষণ সময় ধরে রোদ পোহাতে হবে। তবে সূর্যের তাপ ছাড়াও কতিপয় খাবার থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। যেমনঃ স্যালমন ফিশ, টুনা ফিশ, কড লিভার অয়েল, লাল মাংস, ডিমের কুসুম, গরুর দুধ, মাশরুম, কমলা লেবুর রস, শস্যদানা ইত্যাদি। এছাড়াও বাজারে ভিটামিন ডি ট্যাবলেট কিনতে পাওয়া যায় যা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করার মাধ্যমে শরীরে ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।‌ 

শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাবে কি হয় জানতে পড়ুন

ঘুম

মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে hGH (human growth hormone) হরমোন নিঃসরণ হয় যা শরীরের বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারো শরীরে hGH হরমোনের অভাব হলে উচ্চতা বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আর মজার একটি বিষয় হলো, বিশেষ এই হরমোনটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণে নিঃসরণ হয় ঘুমের সময়। অর্থাৎ, hGH হরমোন নিঃসরণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে। কিশোর বয়সে প্রতিদিন রাতে ৮ থেকে ১০ ঘন্টা ঘুমাতে হবে এবং কম বয়সী মানুষের জন্য আরো বেশি সময় ঘুমানো উচিত। সেই সাথে দিনের বেলায় পাওয়ার ন্যাপ (Power naps) নেওয়া উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। (Silver, 2022)

ব্যায়াম 

সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। শরীরে অতিরিক্ত ফ্যাট বা চর্বি জমে গেলে তা যেমন হার্টের রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় তেমনিভাবে গ্রোথ হরমোন (hGH) নিঃসরণ কমিয়ে দিতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে শরীরের ফ্যাট কমানো সম্ভব এবং সেই সাথে hGH এর নিঃসরণ বেড়ে গিয়ে শরীরের উচ্চতা বাড়াতে সহায়তা করবে। যেকোনো ধরনের ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে উপকারিতা পাওয়া সম্ভব। দৈনিক কমপক্ষে একঘন্টা সময় শারীরিক পরিশ্রমের কাজ অথবা ব্যায়ামের জন্য বরাদ্দ রাখুন। 

পেটের মেদ কমানো 

পেটের মেদ বেড়ে গেলে বা ভুঁড়ি হলে তা যেমন দেখতে ভালো লাগে না তেমনিভাবে শরীরের উচ্চতায় দুই ভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রথমত পেটে জমা হওয়া ফ্যাট শরীরের অন্যান্য ফ্যাটের মতোই hGH হরমোন নিঃসরণে বাঁধার সৃষ্টি করে।‌ আর‌ দ্বিতীয়ত ভুঁড়ি হলে তা শরীরের সামনের দিকে ঝুঁকে আসে।‌ যার ফলে মেরুদন্ড কিছুটা সামনের দিকে বেঁকে গিয়ে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে। মেরুদণ্ড সোজা থাকলে একজন মানুষকে যতটা লম্বা দেখা যাবে সামনের দিকে বেঁকে গেলে উচ্চতা কিছুটা কম দেখা যাবে। আর তাই পেটে মেদ জমে ভুঁড়ি যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। 

পেটের মেদ কমানোর উপায় জানতে পড়ুন

সঠিক দেহভঙ্গি (Posture)

সঠিক দেহভঙ্গি মেনে দাঁড়ানো ও বসার অভ্যাস না করলে এর প্রভাবে ঘাড় ও কোমড়ে ব্যথা হতে পারে এবং সেই সাথে আপনি যতটা না খাটো তারচেয়ে বেশি খাটো দেখাবে। আর তাছাড়া সঠিক দেহভঙ্গি অনুসরণ করার মাধ্যমে নিজের ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠে। দাঁড়ানোর সময় দুই পায়ের উপর সমান ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে যেন ঘাড়, কাধ, কোমর ও হাঁটু সোজা থাকে। বসার ক্ষেত্রে সামনের দিকে না‌ ঝুঁকে বরং শিরদাঁড়া সোজা‌ রেখে বসার অভ্যাস করতে হবে। 

ইয়োগা (Yoga)

নিয়মিত ইয়োগা প্র্যাকটিস করা শরীরের উচ্চতা বাড়তে সহায়তা করে। ইয়োগা করার জন্য সহায়তা হিসেবে ইউটিউব দেখা অথবা এই বিষয়ে এক্সপার্ট কারো কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। 

বাজারে অনেক ফুড সাপ্লিমেন্ট ও হারবাল ঔষধ পাওয়া যায় যেগুলো শরীরের উচ্চতা বাড়াতে পারে বলে দাবি করা হয়। বস্তুত এগুলোর বেশিরভাগই তেমন কোনো কাজে আসে না।‌ বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে কোনো ঔষধ, সাপ্লিমেন্ট ও চিকিৎসা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন এবং নিজের শরীরের উচ্চতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার চেষ্টা করুন।‌ তবে আপনার যদি মনে হয় যে, আপনার উচ্চতা স্বাভাবিক ভাবে বাড়ছে না এবং এর জন্য কোনো বিশেষ রোগ বা হরমোনজনিত সমস্যা থাকতে পারে তবে সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে। 

References

Fletcher, J. (2022, December 22). Can adults grow taller? Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/319504

Silver, N. (2022, July 25). How to Increase Your Height: Is There Anything I Can Do? Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/how-to-increase-height

Last Updated on April 12, 2023