চুল ঝরে যাওয়ার সমস্যা শুনলেই প্রথম কোন মহৌষধের কথা বলা হয় বলুন তো? সেই দাদী-নানিদের আমল থেকেই চুল ঝরে যাওয়া বা চুল দ্রুত বড় করার জন্য মহৌষধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে ক্যাস্টর অয়েল। যে কারনে এই তেলের নামটিও আমাদের সবার কাছেই কম বেশি বেশ পরিচিত। তবে শুনে অবাক হবেন যে, ক্যাস্টর গাছের বীজ থেকে আহরণ করা প্রচণ্ড ঘন এই তেলটির গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার ছিলো বহু বহু বছর আগের প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতাতেও। প্রথমে লন্ঠনের বাতি জ্বালাতে এর ব্যবহার শুরু হলেও, পরবর্তীতে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা এবং রুপচর্চার কাজে এই তেলটি ব্যাপকভাবে গুরুত্বের সাথে ব্যবহার হতে থাকে। শুরুটা প্রাচীন মিসরে হলেও, বর্তমান এই সময়ে পুরো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ক্যাস্টর অয়েল উৎপাদন হয় ভারতে।

এক টেবিল চামচ ক্যাস্টর অয়েলে রয়েছে:

  • ক্যালরিঃ ১২০ গ্রাম
  • ফ্যাটঃ ১৪ গ্রাম

আচ্ছা, চুলের যত্নে ক্যাস্টর অয়েলের কার্যকারিতা তো অনস্বীকার্য। এটা মোটামুটি সবাই জানি। কিন্তু চুল ছাড়াও শরীর ও স্বাস্থ্যের আরো নানাবিধ দিকেও যে রয়েছে ক্যাস্টর অয়েলের বিভিন্ন ব্যবহার, সেটা আমরা কয়জন জানি? আজ তেমনই কয়টি ব্যবহার নিয়ে জানাবো আপনাদের।

চুল ছাড়াও ক্যাস্টর অয়েলের অন্যান্য কিছু উপকারিতাঃ

১. মাংসপেশি ও হাড়ের ব্যাথা উপশমেঃ

ক্যাস্টর অয়েলের আছে এন্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ক্ষমতা। অর্থাৎ, এটি নানারকম, ব্যাথা, জ্বালা পোড়া, অস্বস্তি কমাতে সক্ষম। শরীরের বিভিন্ন অংশের পেশি ও হাড়ের ব্যাথা বা আর্থ্রাইটিসের ব্যাথা, বা কোন পেশিতে টান লেগে ব্যাথা, আড়ষ্টতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে, ব্যাথার যায়গায় গরম পানির সেকের সাথে ক্যাস্টর অয়েলের মালিশ যথেষ্ট কার্যকরী। ব্যাথার পাশাপাশি শরীরের কোন অংশে ফোলা থাকলে, সেটা উপশমেও কাজ করে ক্যাস্টর অয়েল।

কিন্তু, চামড়ার উপরে তেল মালিশ করেই কী করে ব্যাথা, ফোলা বা আড়ষ্টতা দূর হতে পারে? চামড়ায় মালিশের সাথে আমাদের ত্বক বা চামড়া তেলটিকে শোষণ করে নেয়। ত্বকের অভ্যন্তরে গিয়ে ক্যাস্টর অয়েল আমাদের শরীরের থাইমাস গ্ল্যান্ডকে জাগিয়ে তোলে। যার ফলে শরীরে লিম্ফোসাইট নামক শ্বেত রক্তকনিকার বিকাশের সাথে উন্নতি হয় শরীরের রক্ত প্রবাহতেও। এর ফলাফল হিসেবে শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যাথা, পেশির টান, আড়ষ্টতা কমার পাশাপাশি বেড়ে যায় সেখানকার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও।

২. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেঃ

কোষ্ঠকাঠিন্য এর মতো কষ্টকর সমস্যার ক্ষেত্রে কিন্তু ক্যাস্টর অয়েলের কার্যকারিতা বেশ পরীক্ষিত। ক্যাস্টর অয়েল অন্ত্রের পেশিগুলোর কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে, যেন তারা অন্ত্রে আটকে থাকা বর্জ্যগুলোকে দ্রুত ও সহজে বের করে দিতে পারে। অর্থাৎ, রেচন ক্রিয়ায় সাহায্য করে।

এখন বলি ক্যাস্টর অয়েল মানুষের পেটে গিয়ে এই কাজটি করে কীভাবে। মুখে ক্যাস্টর অয়েল খাওয়ার পরে এটি মানবদেহের ক্ষুদ্রান্তে গিয়ে বিভিন্ন অংশে ভেঙ্গে যায়। মুক্ত হয় এতে থাকা মূল ফ্যাটি এসিড। যার বৈজ্ঞানিক নাম রাইসেনোলিক এসিড (Ricinoleic Acid)। এই এসিডটিকে অন্ত্র পুরোপুরি শোষণ করে নিয়ে তৈরি করে একটি কার্যকরী রেচক (Laxative)। বাংলায় যার অপর নাম ‘মল নিঃসারক’। সহজ ভাষায় বললে, যে উপাদান শরীরে থাকা মল ও বর্জ্যকে সহজে শরীর থেকে বের হতে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, এইটুকু বলাই যায় যে, কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে ভুক্তভোগীদের মলত্যাগের কষ্টকর প্রক্রিয়াকে সহজ করতে ক্যাস্টর অয়েল খুবই কার্যকরী।

তবে নিজে থেকে ক্যাস্টর অয়েল খেয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাইলে, পরিমাণে সামান্য করে খাওয়াই শ্রেয়। হঠাত বেশি খেয়ে ফেললে, পাতলা পায়খানা, বমি, মাথা ঘুরানোর মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে থেকে এমন কিছুই খাওয়া উচিত হবে না।

৩. ত্বকের বলিরেখা দূর করতে ও ত্বকের যত্নেঃ

ক্যাস্টর অয়েলে আছে এমন কিছু কার্যকরী এন্টি-অক্সিডেন্ট, যা ত্বকের ফ্রি-র‍্যাডিকেলের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা রাখে। আমাদের ত্বকে বয়সের ছাপ, বলিরেখা ইত্যাদি ত্বরান্বিত করার জন্য কিন্তু দায়ী এই ফ্রি-র‍্যাডিকেলই। সুতরাং এই ফ্রি-র‍্যাডিকেলের সাথে লড়াই করা মানে যেন, ত্বকে বলিরেখার আগমনকেই আটকানোর প্রচেষ্টা। এছাড়াও ক্যাস্টর অয়েলে থাকা ভিটামিন-ই ত্বকের ইলাস্টিন ও কোলাজেনের বৃদ্ধি বাড়ায়। এই দুটি উপাদানই কিন্তু ত্বকের সজীবতা ও টানটান ভাব ধরে রাখার জন্য দায়ী। (Osborn, C. O. 2018)

ক্যাস্টর অয়েল ত্বকে ব্যবহার করলে অনেক ক্ষেত্রে এটি ত্বকের একনি, পিম্পল দূর করতেও কাজ করে। কারণ, ঘন এই তেলটির রয়েছে এন্টি ব্যাকটেরিয়াল ক্ষমতাও! এতে আরো আছে ফ্যাটি এসিড। ত্বককে আর্দ্র রাখার পাশাপাশি, ত্বকের টিস্যুগুলোর বিকাশ অক্ষুণ্ণ রেখে, ত্বককে দাগহীন ও উজ্জ্বল রাখতে ফ্যাটি এসিড খুবই দরকারি। আর যেহেতু সেই ফ্যাটি এসিড ক্যাস্টর অয়েলে পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে এটাও বলা যায় যে, ত্বকের হাইপার পিগমেন্টেশন দূর করতে, দাগহীন, উজ্জ্বল ও আর্দ্র রাখতে ক্যাস্টর অয়েলের ব্যবহার অবশ্যই কার্যকরী।

তবে কারো ত্বক যদি অতি মাত্রায় তৈলাক্ত হয়, সেক্ষেত্রে ত্বকে ক্যাস্টর অয়েল ব্যবহার না করাই ভালো হবে। তবে শুষ্ক ত্বক যাদের, তাঁদের জন্য এই তেলটি হতে পারে জাদুকরি। কারণ, শুষ্ক ত্বকের অধিকারীরাই বিশেষ করে বলিরেখাসহ ত্বকের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগেন, শুষ্কতার কারনে। সেক্ষেত্রে তারা রাতে ঘুমানোর আগে ময়েশ্চারাইজার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন সামান্য ক্যাস্টর অয়েল। যদি না এলার্জি জাতীয় কোন সমস্যা থাকে, শুষ্ক ত্বকের অধিকারীদের ত্বকের শুষ্কতা রোধসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ক্যাস্টর অয়েল কাজ করবে জাদুর মতোই!

৪. ক্ষতস্থান দ্রুত ভালো করতেঃ

ইতোমধ্যেই বলা হয়ে গেছে যে ক্যাস্টর অয়েলে আছে ফ্যাটি এসিড ও এন্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান। এগুলো কিন্তু যে কোন কাঁটা, ছেড়া, ছিলে যাওয়া, ঘা, ক্ষতস্থানের চিকিৎসাতেও কার্যকরী। কারণ এতে থাকা এন্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান ক্ষতস্থানে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ও ইনফেকশন রোধ করে। অনেক সময় ক্ষতস্থান শুকাতে শুরু করলে চামড়ায় টান পড়ে চুলকানি হয়, কখনো আবার টানটান চামড়া পুনরায় ছিঁড়ে ক্ষতস্থান উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রেও ক্যাস্টর অয়েল ক্ষতস্থানের চামড়ায় আর্দ্রতা বজায় রেখে এসব সমস্যা রোধ করতে পারে।

ক্যাস্টর অয়েলে থাকা যে মূল ফ্যাটি এসিড, রাইসেনোলিক এসিড (Ricinoleic Acid)। এটিতে আছে এন্টি ইনফ্ল্যামেটরি ক্ষমতা। অর্থাৎ এটি জ্বালা-পোড়া, ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে।

এতোসব ক্ষমতার কারনে চিকিৎসাবিজ্ঞানে রীতিমতো শক্তভাবেই নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছে ক্যাস্টর অয়েল। জেনে অবাক হবেন যে, ক্ষতস্থানে বহুল ব্যবহৃত বিভিন্ন অয়েনমেন্টে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বাণিজ্যিকভাবেই ব্যবহার হচ্ছে ক্যাস্টর অয়েল।

শেষ কথাঃ

ক্যাস্টর অয়েলের গন্ধ, ঘনত্ব ও প্রচণ্ড আঠালো ভাবের কারনে অনেকেই নিজের শরীরে, ত্বকে বা চুলে এর ব্যবহার করতে পছন্দ করেন না। তবে, যতই অপছন্দ হোক না কেন, চুল নিয়ে মারাত্মক সমস্যায় পড়লে অনেকেই না চাইতেও শরণাপন্ন হন ক্যাস্টর অয়েলের। কিন্তু চুল ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে তেলটির ব্যবহার হয়তো খুব কম মানুষই করে থাকেন। বেশিরভাগ মানুষ হয়তো জানেনই না, চুল ছাড়াও যে এতো উপকারিতা আছে এই ক্যাস্টর অয়েলের। এতো সব উপকারী দিকের কথা বিবেচনা করলে বলা যায়, বাজারে এর দামটাও বেশ হাতের নাগালেই।

আশা করি, ক্যাস্টর অয়েলের উপকারিতার ভিন্ন যে দিক গুলো আপনাদের জানিয়েছি, সেগুলো আপনাদের উপকারে আসবে। তবে ক্যাস্টর অয়েলের মতোই, যে কোন কিছুই মুখে খাওয়া বা ত্বকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথমে খুব সামান্য ব্যবহার করে পরীক্ষা করে নিতে হবে যে, এটি ব্যবহারকারীর এলার্জির কোন আশঙ্কা আছে কিনা।

 

References

Osborn, C. O.(2018, November 14). Can You Use Castor Oil on Your Face?. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/castor-oil-for-face

Last Updated on December 18, 2023