সায়াটিকা (Sciatica) নিরাময়ের উত্তম উপায় হলো নিয়মিত ব্যায়াম করা “তথ্য হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলে”। (Harvard Medical School, 2022) কিন্তু এক্ষেত্রে কোন ধরনের ব্যায়াম সবচেয়ে ভালো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

এই অনুচ্ছেদে সায়াটিকার ৩ টি সহজ ব্যায়াম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সেই সাথে আপনার যদি সায়াটিকা সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকে তবে অনুচ্ছেদের শুরুতেই সায়াটিকা কি, কেন হয়, চিকিৎসা পদ্ধতি, ওষুধ এবং ব্যথা নিরাময়ে করণীয় বিষয়াবলী গুলো জানতে পারবেন।

সায়াটিকা কি?

সায়াটিক নার্ভ (Sciatic nerve) মানুষের দেহের সবচেয়ে দীর্ঘতম স্নায়ু যা কোমরের নিচ থেকে শুরু হয়ে নিতম্বের পেছনের অংশ বেয়ে পায়ের দিকে নেমে গেছে। সায়াটিক নার্ভের এরিয়াতে যে ব্যথা হয় তাকে বলা হয় সায়াটিকা। সাধারণত সায়াটিকা শরীরের একপাশে হয়ে থাকে তবে কদাচিৎ ক্ষেত্রে দুই পাশেও হতে পারে।

সায়াটিক নার্ভের জ্বালাপোড়া বা প্রদাহ একটি অস্বস্তিকর ব্যথা তৈরি করে যা কোমর থেকে হাঁটুর নীচে পর্যন্ত প্রসারিত হয়। অনেকের ক্ষেত্রে ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে উঠে দাঁড়ানোর মত অবস্থা থাকে না। এক্ষেত্রে ব্যথা ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি লক্ষণ দেখা যেতে পারে। যেমনঃ

  • পা ভারী হয়ে যাওয়া
  • পায়ে টান ধরা
  • চরম অস্বস্তি অনুভূত হওয়া
  • পায়ে দুর্বলতা বোধ ইত্যাদি

সায়াটিকা কেন হয়?

নানাবিধ কারণে সায়াটিক নার্ভে প্রদাহ হতে পারে। এই প্রদাহের পেছনে সবচেয়ে কমন কারণ হলো হার্নিয়েটেড ডিস্ক (herniated disk) বা মেরুদণ্ডের হাড়ের মাঝে থাকা ডিস্কের গঠনগত পরিবর্তন যা সায়াটিক নার্ভকে প্রেশার করে এবং সংকুচিত করে ফেলে। এছাড়াও স্পাইনাল স্টেনোসিস (Spinal stenosis) বা মেরুদণ্ডের সংকীর্ণতা এবং পিরিফোর্মিস সিনড্রোম (Piriformis syndrome) নামে পরিচিত একটি সমস্যার জন্যও সায়াটিক নার্ভে ব্যথা হতে পারে। খুবই বিরল ক্ষেত্রে হার্পিস বা জ্বরঠোসার সংক্রমণে সায়াটিকা হয়ে থাকে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে স্নায়ু বা নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এই সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।

এই ধরণের সমস্যাগুলো সাধারণত বয়স্ক মানুষ এবং যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন না অথবা যাদের শরীরের ওজন বেশি তাদের ক্ষেত্রে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও দীর্ঘ সময় ধরে শুয়ে বসে থাকা এবং যারা খুব বেশি ওজন তোলেন অথবা ভারী কাজ করেন বা পিঠে চাপিয়ে ভারী ওজন তোলার কাজ করেন তাদের বেলায় অধিক ঝুঁকি রয়েছে। যেমনঃ ইলেকট্রনিক্সের দোকান গুলোতে ফ্রিজ বা ওয়াশিং মেশিন উঠানো ও নামানোর কাজ করা।

সায়াটিকা রোগের চিকিৎসা

সায়াটিকার চিকিৎসার জন্য একজন অর্থোপেডিক অথবা নিউরোসার্জন ডাক্তার দেখাতে হবে। সায়েটিকার জন্য সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। আবার মেরুদণ্ডের হাড়ের সমস্যা খুব বেশি হলে সেক্ষেত্রে সার্জারি করানো লাগে।

চিকিৎসার পাশাপাশি এই রোগে বিশ্রামের প্রয়োজন হয় অনেক বেশি তবে খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। কারণ একেবারে কোনো পরিশ্রম না করে সবসময় বিশ্রামে থাকলে সায়াটিকার লক্ষণ আরো বেড়ে যায়।

সায়াটিকা রোগের ঔষধ

সায়াটিকার ঔষধ হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ে NSAID গ্রুপের ওষুধ গুলো যেমন প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই খাওয়া যেতে পারে। কারণ এগুলো ওটিসি (OTC- over the counter) গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত যা বেশ নিরাপদ।

এছাড়াও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথা নাশক ওষুধ সহ বিশেষ প্রয়োজনে স্টেরয়েড (Steroids) গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে মনে রাখবেন দীর্ঘদিন যাবত ব্যথা নাশক ওষুধ বা স্টেরয়েড গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিশেষত কিডনি ও লিভার।

আইবুপ্রোফেন সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

সায়াটিকার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা 

সায়াটিকার জন্য বিকল্প ধারার চিকিৎসা হিসেবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন। হোমিওপ্যাথি একটি নিরাপদ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে সমাদৃত। সায়াটিকার ব্যথা ও যন্ত্রণা নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিক কতকগুলো ওষুধ বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখে। যেমনঃ

  • Arnica montana
  • Colocynth
  • Gnaphalium polycephalum
  • Hypericum perforatum
  • Mag phos 6x
  • Rhus tox
  • Ruta grave etc.

উল্লেখিত ওষুধগুলো অবশ্যই একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী সেবন করতে হবে। তবে ওটিসি ওষুধের মতো Ischialgia- Sciatica drops (R 71) ওষুধটি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই সেবন করে অনেকটা সুফল পাওয়া যায়।

সায়াটিকা সারানোর আরও উপায়

প্রাথমিক পর্যায়ে সায়াটিকার ব্যথা নিরাময়ের জন্য অথবা সায়াটিকার ওষুধ‌ সেবনের পাশাপাশি কয়েকটি ঘরোয়া পদ্ধতি বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমনঃ

গরম পানিতে গোসল

গরম পানিতে গোসল করলে সায়াটিকার ব্যথা অনেকটাই কমে যায়। এক্ষেত্রে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে হবে এবং আপনি চাইলে পানির সাথে খানিকটা ইপসম সল্ট (Epsom salt) মিশিয়ে নিতে পারেন। এটি একধরনের লবণ যার রাসায়নিক নাম Magnesium sulfate এবং বাজারে অহরহ কিনতে পাওয়া যায়। এছাড়াও গরম পানি একটি বোতলে অথবা Hot Water Bag এ ভরে ব্যথার স্থানে লাগানোর মাধ্যমে আরাম পাওয়া যায়।

বরফ সেঁক

গরম পানির মতো ঠান্ডা সেঁক দেওয়ার মাধ্যমেও সায়াটিকার যন্ত্রণা কমে যায়। এক্ষেত্রে কয়েক টুকরো বরফ একটি কাপড়ের মধ্যে পেঁচিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগাতে হবে। তবে আপনার ক্ষেত্রে যদি ঠান্ডা সেঁক দিলে আরাম না হয় তবে গরম সেঁক চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

যোগাসন 

গবেষণায় দেখা গেছে যে, যোগাসন করার মাধ্যমে সায়াটিকার‌ যন্ত্রণা কমে যায়। (Cronkleton, 2019) তবে ঠিক কিভাবে যোগাসন করতে হবে সেই ব্যাপারে সঠিক নির্দেশনা পেতে কোন একটি যোগাসনের ক্লাসে জয়েন করুন।

মাসাজ (Massage)

মাসাজের ফলে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং মাংসপেশী রিল্যাক্স হয় যা সায়াটিকার যন্ত্রণা কমাতে সহায়তা করে। মাসাজের জন্য একজন ফিজিওথেরাপিস্ট অথবা স্পা (Spa) সেন্টারে  যেতে পারেন।

সায়াটিকারর সহজ ব্যায়াম

সায়াটিক স্নায়ুতে প্রদাহ হলে বেশ লম্বা সময়ের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। আর তাই আজকে আমরা এমন কিছু exercise বা অনুশীলন শেয়ার করব যা সায়াটিক নার্ভ ব্যথার চিকিৎসায় বেশ কার্যকরী। একইসাথে এই অনুশীলনগুলো আপনার জীবন যাত্রার মান উন্নত করবে। তাহলে চলুন এই পর্যায়ে exercise গুলো সম্পর্কে জানা যাক-

Exercise No 1

সায়াটিকারর ব্যায়াম

সমতল মেঝেতে বসুন। অতঃপর বুকের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বা বুক বরাবর একটি হাঁটু বাঁকিয়ে একটি পা ছবির মতো করে ধরুন। এভাবে ১০ ​​সেকেন্ড ধরে রাখুন এবং এই সময়ে আপনার অন্য পা’টি যেন সোজা থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন। ১০ সেকেন্ড পর অন্য পায়ের ক্ষেত্রেও একই রকম ভাবে ব্যায়ামটি করুন। এভাবে ১০ থেকে ১৫ বার করে সকাল এবং বিকালে ব্যায়ামটি করতে থাকুন।

 

Exercise No 2 

সায়াটিকার ৩ টি সহজ ব্যায়াম

প্রথম ব্যায়াম টি শেষ করার পর মেঝেতে শুয়ে পড়ুন। হাত দুটো সোজা এবং টানটান করে মেঝেতে রাখুন। এবার দুটো পা’ই একসাথে নরম করে উপরের দিকে তুলুন। এবার হাঁটু থেকে পায়ের নিচের অংশটুকু মেঝের দিকে কিছুটা ঝুঁকিয়ে দিন। এভাবে রাখলে পায়ের শেপ অনেকটাই ‘V’ এর মত দেখা যাবে। খেয়াল রাখবেন, পুরোপুরি ৯০ ডিগ্রি কোণে বাঁকানোর দরকার নেই। ব্যাস! শেপ হয়ে গেল। এখন হাঁটু পর্যন্ত স্থির রেখে হাঁটুর নিচের অংশ টুকু ৫ বার উপরে উঠাবেন এবং নিচে নামাবেন। ছবির মতো করে ব্যায়ামটি বসেও করতে পারেন। অথবা একই পদ্ধতিতে শুয়ে থেকে ব্যায়াম করবেন।

 

Exercise No 3

সায়াটিকারর সহজ ব্যায়াম

সায়াটিকারর সহজ ব্যায়াম

সমতল মেঝেতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ুন। এবার একটি পায়ের হাঁটু বাকিয়ে বা ভাঁজ করে বুক বরাবর নিয়ে এসে ১০ ​​সেকেন্ডের জন্য ধরে থাকুন। এই ব্যায়ামটি করার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখবেন যেন পিঠ এবং অন্য পা’টি মেঝে থেকে উঠে না যায়। একইভাবে অন্য পায়ের ক্ষেত্রেও এভাবে ১০ সেকেন্ডের জন্য ব্যায়াম করুন। খেয়াল রাখবেন, exercise করার সময় যেন কোনো ভাবেই ব্যথা না লাগে। তাই বডিকে যতটুকু সম্ভব রিলাক্স রাখবেন। এবার, আস্তে করে পুরো শরীর মেঝেতে ছেড়ে দিয়ে শরীর সমতল থাকা অবস্থায় ব্যায়াম শেষ করুন।

যদিও এই ব্যায়াম গুলো সায়াটিক নার্ভের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অনেক বেশি কার্যকরী, তবুও আপনার অবস্থার উপর ভিত্তি করে ব্যায়াম করার আগে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নেয়া ভালো। মনে রাখবেন, যেহেতু নানাবিধ কারণে সায়াটিক স্নায়ু প্রদাহ হয় আর তাই কারণ অনুযায়ী এর চিকিৎসা পদ্ধতিও আলাদা হতে পারে।

সায়াটিকা হলে যেমন ব্যায়ামের মাধ্যমে বেশ উপকার পাওয়া যায় তেমনি ভাবে একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে আপনি নিয়মিত ব্যায়াম করতে থাকলে তা ভবিষ্যতে সায়েটিকা হওয়ার সম্ভাবনা কমাতে পারে বলে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাম্প্রতিক সময়ের একটি প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়েছে। (Harvard Medical School, 2022) আর তাছাড়া এমনিতেও শরীরকে সুস্থ এবং ঝরঝরা রাখার জন্য আপনার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত।

 

 

 

 

References

Cronkleton, E. (2019, 7 24). 10 Yoga Poses for Sciatica Pain Relief. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/yoga-for-sciatica

Harvard Medical School. (2022, march 21). 5 tips for coping with sciatica. Retrieved from harvard health publishing: https://www.health.harvard.edu/pain/5-tips-for-coping-with-sciatica

 

 

Last Updated on April 27, 2023