ইউরিন ইনফেকশন কি এবং কেন হয়?

ইউরিন ইনফেকশন বা Urinary Tract Infection (UTI) খুবই সাধারণ একটি স্বাস্থ্য সমস্যা বিশেষ করে নারীদের জন্য। এমন নারীর সংখ্যা খুবই কম রয়েছে যারা কখনো ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত হয় নি। তবে তাই বলে যে পুরুষদের এই সমস্যা একদমই হয় না তা কিন্তু নয়। বরং এটি নারী এবং পুরুষ উভয়ের হতে পারে। তবে নারীদের মূত্রনালীর (Urethra) দৈর্ঘ্য ছোট হওয়া এবং সেই সাথে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জটিলতার দরুন নারীদের ক্ষেত্রে ইউরিন ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যায়।

সাধারণত E. coli নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা মূত্রথলী (Urinary Bladder), কিডনি, কিংবা বৃক্কনালীতে (Ureter) সংক্রমণ সৃষ্টির মাধ্যমে ইউরিন ইনফেকশন হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হয়। যেমনঃ (McIntosh, 2022)

  • দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্রাবের বেগ চেপে রাখা
  • পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনীহা
  • দীর্ঘদিন ধরে ক্যাথেটার (Catheter) ব্যবহার করা
  • কিডনিতে পাথর (Kidney Stone)
  • পুরুষের প্রস্টেট গ্রন্থির রোগ
  • গর্ভকালীন সময়
  • ডায়াবেটিস ইত্যাদি

ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ গুলো কি কি?

নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ইউরিন ইনফেকশনের ফলে প্রায় একই রকম লক্ষণ দেখা দেয়। যেমনঃ

  • ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হওয়া
  • খুব অল্প পরিমাণে প্রস্রাব হওয়া
  • প্রস্রাব করার সময় মূত্রনালীতে জ্বালা বা প্রদাহ অনুভূত হওয়া
  • ঘোলাটে প্রকৃতির প্রস্রাব
  • প্রস্বাবে ঝাঁঝালো গন্ধ থাকে
  • জ্বর ও শীতবোধ
  • দূর্বলতা ও ক্লান্তি

ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ হিসেবে তীব্র জ্বর,‌ খিটখিটে মেজাজ, খাবারের প্রতি অনিহা এবং বমি দেখা দিতে পারে। ইউরিন ইনফেকশন খুব সাধারণ প্রকৃতির রোগ মনে হলেও অবহেলায় এটি জটিল এবং মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি তা কিডনি বিকল (Damage) করে দিতে পারে। আর তাই লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিৎ।

অনেকেই এই রোগটিকে খুব লজ্জাজনক মনে করে বিভ্রান্তিতে পড়ে যায় এবং কারও কাছে প্রকাশ না করে গোপন রাখার চেষ্টা করে। এতে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায় কারণ যদি প্রকৃতপক্ষেই ইউরিন ইনফেকশন হয়ে থাকে তবে তা সময়ের সাথে সাথে আরো জটিলতর হতে থাকবে। আপনার ক্ষেত্রে ইউরিন ইনফেকশন হয়েছে কিনা তা নিজে নিজেই নিশ্চিতভাবে জানার জন্য নিকটস্থ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই একটি সহজ পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এই পরীক্ষাটির নাম হলো Urine R/E যাকে সহজ বাংলায় ‘প্রস্রাব পরীক্ষা’ বলা হয়।

আরো পড়ুন: পুরুষের দুর্বল বীর্যপাতের কারণ এবং চিকিৎসা

ইউরিন ইনফেকশন হলে কি করা উচিত?

ইউরিন ইনফেকশন একটি ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ আর তাই এই রোগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী এন্টি বায়োটিক ওষুধ সেবন করতে হবে। তবে এর পাশাপাশি কতিপয় ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করলে তা দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। যেমনঃ

১। প্রচুর পানি পান করতে হবে

আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ২০% পানি বিভিন্ন খাদ্য থেকে আসে এবং বাকি ৮০% পানি পান করার মাধ্যমে চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। ইউরিন ইনফেকশন সমস্যা সমাধানের জন্য ডাক্তাররা প্রচুর পরিমাণে পানি পান করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কারণ, এতে করে প্রস্রাবের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং বেশি বেশি প্রস্রাবের ফলে ব্যাকটেরিয়া শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। সাধারণত পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতিদিন কমপক্ষে ২ থেকে ২.৫ লিটার এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ১.৫ থেকে ২ লিটার পানি পান করতে হবে। সেই সাথে শরবত, ডাবের পানি ইত্যাদি খাওয়া উপকারি হতে পারে।

২। তাপ

ইউরিন ইনফেকশনের কারণে মহিলাদের পিউবিক এরিয়াতে প্রচন্ড চুলকানি, জ্বালা এবং ব্যাথার উদ্রেক হতে পারে। একটি ‘তাপীকরণ’ বা ‘হিটিং প্যাডের’ সাহায্যে এই সমস্যাগুলো দূর করা যেতে পারে। ‘হিটিং প্যাড’ ব্যবহার করার আগে সহনীয় পর্যায়ে তাপ কমিয়ে নিতে হবে এবং এটি একটানা ১৫ মিনিটের বেশি ব্যবহার করা উচিৎ নয়। কারণ, পিউবিক এরিয়ার ত্বক খুবই নাজুক প্রকৃতির হয়ে থাকে আর তাই এটি সরাসরি ত্বকে না দিয়ে একটি পাতলা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে ব্যবহার করতে হবে।

৩। ব্লাডার বা মূত্রথলী খালি রাখতে হবে

প্রস্রাবের চাপ আসা মাত্রই উচিৎ ব্লাডার খালি করা তথা প্রস্রাব করা। কারণ, ব্লাডার বা মূত্রথলীতে প্রস্রাব জমা থাকলে সেখানে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ পায়। আর তাই প্রস্রাবের বেগ চেপে না রেখে যত দ্রুত সম্ভব ব্লাডার খালি করুন।

৪। খ্যাদ্যাভাস

যদি একবার কারো ইউরিন ইনফেকশন হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তাকে খাবার গ্রহণে সতর্ক থাকতে হবে। ক্যাফেইন, এলকোহল, নিকোটিন, কার্বোনেটেড পানীয়, মশলাদার খাবার এবং চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত আরটিফিসিয়াল মিষ্টি ইত্যাদি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, এই সমস্ত খাবার গুলো ইনফেকশন আরো বাড়িয়ে দেবে।

৫। প্রোবায়োটিকস

প্রোবায়োটিকস (Probiotics) হলো শরীরের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া যা মানুষের অন্ত্রে বসবাস করে। এই সব ব্যাকটেরিয়া গুলো শরীরের জন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলতে যেমন সাহায্য করতে পারে তেমনি ভাবে তা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সুস্থ থাকতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। দই, পনির, ভিনেগার ইত্যাদি সহ প্রোবায়োটিকস সমৃদ্ধ ফুড সাপ্লিমেন্ট বাজারে অহরহ কিনতে পাওয়া যায় যা গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের জন্য উপকারী এই ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব হবে।

৬। অন্তর্বাস 

খুব টাইট প্রকৃতির অন্তর্বাস পরিধান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সেই সাথে আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, অন্তর্বাস ধুয়ে দেওয়ার পর তা যেন ভালোভাবে শুকিয়ে তারপরে ব্যবহার করা হয়। কারণ, ভেজা বা আর্দ্র থাকলে তা জীবাণু সংক্রমণের জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়। এছাড়াও অন্তর্বাসের কাপড় সুতি, মসৃণ প্রকৃতির ও পরতে আরামদায়ক হওয়া উচিত।

ইউরিন ইনফেকশন হলে যে খাবার খাবেন

১। ভিটামিন-সি

ইউরিন ইনফেকশনের প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি যুক্ত খাবার যেমনঃ লেবু, কমলা, পেঁপে, আনারস, আঙ্গুর, মালটা ইত্যাদি খেতে হবে। কারণ, ভিটামিন-সি প্রস্রাবকে অনেক বেশি এসিডিক করে ফেলে, যার ফলে মুত্রথলীতে ও নালীতে ব্যাকটেরিয়ার অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

২।  কালোজাম

কালোজাম অনেক সুস্বাদু একটি দেশীয় ফল। এতে ব্যাকটেরিয়া ধবংস করার এমন বিশেষ কিছু গুণ রয়েছে যা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। অন্যান্য খাবারের সাথে প্রতিদিন কিছু সংখ্যক কালোজাম অথবা কালোজামের রস বানিয়ে খেতে পারেন। এটি আপনার ইউরিন ইনফেকশন প্রতিকার সহ প্রতিরোধের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

৩। আপেল সাইডার ভিনেগার

আপেল সাইডার ভিনেগারে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে এনজাইম, পটাশিয়াম, ভিটামিন এবং খনিজ। এই উপাদানগুলো ইউরিন ইনফেকশনের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াগুলো ধ্বংস করার জন্য কার্যকারী ভূমিকা পালন করে। ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য আপেল সাইডার ভিনেগার একটি প্রাকৃতিক এন্টিবায়োটিক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

আপেল সিডার ভিনেগারের উপকারিতা সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।‌

এক গ্লাস পানির সাথে দুই টেবিল চামচ আপেল সাইডার ভিনেগার মিশিয়ে পান করুন। স্বাদ বাড়ানোর জন্য আপনি চাইলে এর সাথে লেবুর রস এবং মধু মিশিয়েও খেতে পারেন। কার্যকরী ফলাফল পেতে এই পানীয়টি টানা কয়েকদিন প্রতিদিন দুইবেলা পান করতে হবে।

ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধ

ইউরিন ইনফেকশন খুবই অস্বস্তিকর এবং যন্ত্রণাদায়ক একটি রোগ। আর তাই এই রোগ যেন না হয় সেজন্য সর্বদা সচেতন থাকা উচিত। ইউরিন ইনফেকশন প্রতিকারে যেসমস্ত ঘরোয়া পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলোই এক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। যেমনঃ

  • কখনো প্রস্রাবের বেগ চেপে না রেখে বরং যথাসময়ে প্রস্রাব করা
  • শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত পানি পান এবং সেই সাথে ফলমূল ও শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে
  • ব্যক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা তথা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে ব্যাপক সচেতন হতে হবে
  • সুগন্ধি যুক্ত অন্তর্বাস অথবা প্যাড ব্যবহার করা যাবে না
  • যৌন মিলনের আগে ও পরে প্রস্রাব করে নিতে হবে
  • মলত্যাগের পর ময়লা হাত যেন প্রস্রাবের রাস্তায় না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে
  • শুষ্ক ও ঢিলেঢালা অন্তর্বাস ব্যবহার করতে হবে

ইউরিন ইনফেকশনের ঔষধের নাম

ইউরিন ইনফেকশনের চিকিৎসায় এন্টি বায়োটিক ঔষধের প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে সাধারণত নিম্নলিখিত ওষুধগুলো রোগ ও রোগীর অবস্থা বিবেচনায় চিকিৎসকেরা নির্বাচন করে থাকেন। যেমনঃ

  • Amoxicillin
  • Ceftriaxone
  • Ciprofloxacin
  • Fosfomycin
  • Levofloxacin
  • Nitrofurantoin
  • Trimethoprim

এছাড়াও রোগীর শরীরে জ্বর থাকলে সেক্ষেত্রে প্রতি ৬ ঘন্টা পর পর অর্থাৎ দিনে ৪ বার ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় প্যারাসিটামল (Paracetamol) ঔষধটি গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। মনে রাখবেন, ইউরিন ইনফেকশনের চিকিৎসায় ডাক্তারের নির্দেশমতো এন্টি বায়োটিকের ডোজ সম্পন্ন করা জরুরী।

 

References

McIntosh, J. (2022, July 24). Urinary tract infection (UTI) symptoms, causes, and remedies. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/189953

 

 

Last Updated on May 31, 2023