আপেল সিডার ভিনেগার বা সিরকার সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। বিশেষ করে আচার বানানোর কাজে এর বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে, প্রতিদিনের ডায়েটে এক টেবিল চামচ পরিমাণ আপেলের ভিনেগার স্বাস্থ্যের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এই অনুচ্ছেদে আপেল ভিনেগারের উপকারিতা, একজন মানুষের জন্য দৈনিক কতটুকু পরিমাণে খেতে হবে, কাদের ক্ষেত্রে খাওয়া নিরাপদ নয় ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সেই সাথে বাড়িতে নিজে নিজে আপেল ভিনেগার বানানোর উপায় জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
আপেল সিডার ভিনেগার কি?
আপেল ভিনেগার হলো আপেল থেকে গাঁজন প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া এসিটিক এসিডের (Acetic acid) জলীয় দ্রবণ। এর মধ্যে ৯৪ শতাংশ পানি, মাত্র ৫ শতাংশ এসিটিক এসিড এবং খুবই সামান্য পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি থাকে। প্রতি ১ টেবিল চামচ পরিমাণ (১৫ মিলি) আপেলের ভিনেগার থেকে মাত্র ৩ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। (Shubrook, 2021)
আপেল ভিনেগার খাওয়ার উপকারিতা
কখনো হেঁচকিতে আক্রান্ত হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। হেঁচকি খুব বিরক্তিকর এবং অস্বস্তিকর একটি অবস্থার সৃষ্টি করে। আপেলের ভিনেগার অস্বস্তিকর এই পরিস্থিতি থেকে খুব সহজেই আপনাকে মুক্তি দিতে পারে। এছাড়াও প্রতিদিনের ডায়েটে আপেলের ভিনেগার রাখলে তা শরীরের জন্য নানাবিধ উপকারী ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমনঃ
১। এসিডিটি সমস্যা ও বুক জ্বালাপোড়া দূর করে
এসিডিটি আমাদের জীবনে একটি নিত্য দিনের সমস্যা। কম বেশি সবাই আমরা এই সমস্যার সম্মুখীন হই। ভিনেগারে রয়েছে রোগ প্রতিরোধকারী বিশেষ কিছু উপাদান যা আমাদের এসিডিটি ও বুক জ্বালাপোড়া সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করবে।
প্রতিদিন সকালে এক গ্লাস পানির সাথে এক চা চামচ পরিমাণ আপেল সাইডার ভিনেগার মিশিয়ে খাবার গ্রহণের আগে পান করুন। এতে করে ফলাফল হিসেবে দেখবেন, এসিডিটির জন্য আপনাকে আর কোনো বাড়তি ওষুধ খেতে হচ্ছে না।
২। আপেল ভিনেগার দিয়ে ওজন কমানোর উপায়
খাবার গ্রহণের আগে অথবা খাবারের সাথে আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার ফলে অনেক সময় পর্যন্ত পেট ভরা থাকে অর্থাৎ দ্রুত ক্ষুধা পায় না। এছাড়াও, এটি পেটের মেদ কমাতে বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখে। একদল মানুষের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে যে, প্রতিদিন ৩০ মিলি পরিমাণ আপেল ভিনেগার ১২ সপ্তাহ ধরে খাওয়ার ফলে পেটের মেদ ও শরীরের ওজন অনেকটাই কমে গেছে। (Wong, 2022)
আর তাই, ওজন কমানোর জন্য দৈনিক ৩ বেলা খাবার গ্রহণের ঠিক আগে ১ চা চামচ পরিমাণ আপেল ভিনেগার ১ গ্লাস পানিতে মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এক মাস পর পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারবেন।
৩। স্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে
আপেলের ভিনেগার রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বিশেষত ট্রাইগ্লিসারিড এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সেই সাথে ভালো কোলেস্টেরল (HDL) এর পরিমাণ বাড়াতে সহায়তা করে যা হার্টের জন্য উপকারী।
লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করে রক্তে সামান্য বেশি পরিমাণে কোলেস্টেরল পাওয়া গেছে কিন্তু চিকিৎসক ওষুধ সেবনের প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন। এমতাবস্থায় সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপনের পাশাপাশি আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়া রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ উপকারী ভূমিকা পালন করে থাকে।
৪। শরীরে ব্লাড সুগার বা চিনির পরিমাণ সঠিক রাখে
আপেলের ভিনেগারে রয়েছে শক্তিশালী এন্টি-গ্লাইসেমিক পদার্থ যা কিছু কিছু শর্করা ভাংতে বাঁধা দেয়। যার ফলে শরীরে ব্লাড সুগার বা চিনির স্তর সবসময় সঠিক থাকে।
আপনি যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনসুলিন নিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে ভিনেগার সেবনের জন্য চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে। কারণ, একইসাথে ইনসুলিন ও ভিনেগার গ্রহণের ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা একদম কমে গিয়ে জটিল সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
৫। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার আমাদের শরীরের জন্য বেশ উপকারী। ভিনেগারে রয়েছে ক্যাটেচিন, গেলিক এসিড, ক্যাফেইক এবং ক্লোরোজেনিক এসিডের মত কার্যকারী এন্টি-অক্সিডেন্ট পদার্থ যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সহজেই রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা হ্রাস করে।
৬। শরীরে পুষ্টি উপাদান বাড়াতে সাহায্য করে
আপেল সাইডার ভিনেগারে থাকা এসেটিক এসিড আপনি যা খাচ্ছেন তা থেকে প্রয়োজনীয় মিনারেল শরীরে শোষণ করে নিতে সাহায্য করে। এছাড়াও এই ভিনেগার সালাদের সাথে মিশিয়ে খেলে সালাদের সবজি থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পুষ্টি শরীর নিতে পারে, কেননা এসেটিক এসিড বেশি পরিমাণে পুষ্টি শোষণ করতে পারে।
আপেল ভিনেগার খাওয়ার নিয়ম

Apple cider vinegar benefits
এক গ্লাস পানিতে ২ টেবিল-চামচ আপেল সাইডার ভিনেগার মিশিয়ে খেতে পারেন। মধু এবং লেবুর শরবতের সাথেও মিশিয়ে খেতে পারেন। যদি আপেল সাইডার ভিনেগারের গন্ধটা পছন্দ না হয় তবে সালাদ অথবা রান্নায় ব্যবহার করে প্রতিদিনের ডায়েটে যোগ করতে পারেন। তবে দৈনিক সর্বোচ্চ ৩০ মিলি এর বেশি মাত্রায় আপেল ভিনেগার খাওয়া উচিত নয়।
আপেলের ভিনেগার এর অন্যান্য ব্যাবহার
শুধুমাত্র খাওয়ার মাধ্যমে নয়, বরং নানাভাবে প্রাত্যহিক জীবনে আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করে সুফল পাওয়া সম্ভব। যেমনঃ
১। ফলমূল ও শাকসবজি ফরমালিন ও জীবাণু মুক্ত করতে সামান্য ভিনেগার খানিকটা পানিতে মিশিয়ে তাতে ভিজিয়ে রাখুন।
২। পোকা মাকড়ের কামড়ে যন্ত্রণা নিবারণের জন্য সামান্য পরিমাণে ভিনেগার সমপরিমাণ পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগানোর মাধ্যমে উপকার পাওয়া যায়।
৩। মাথার খুশকি দূর আপেলের ভিনেগার কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। এই জন্য পানিতে সামান্য পরিমাণে ভিনেগার মিশিয়ে মাথার ত্বকে লাগিয়ে কিছুক্ষণ পর গোসল করে ফেলুন।
৪। অনেকের পা থেকে মোজা খোলার পরে খুব দুর্গন্ধ বের হয়। এমন বিচ্ছিরি অবস্থা থেকে রেহাই পেতে নিয়মিত কয়েকদিন পানিতে ভিনেগার মিশিয়ে পা ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন।
৫। গলা ব্যথা দূর করতে কুসুম গরম পানিতে সামান্য পরিমাণে ভিনেগার মিশিয়ে গড়গড়া করলে উপকার পাওয়া যায়।
সতর্কতা:
✓ আপেল ভিনেগার একধরনের এসিডের দ্রবণ যা দাঁতের এনামেল ক্ষয় করে। আর তাই, সরাসরি ভিনেগার না খেয়ে বরং পানিতে মিশিয়ে খেতে হবে। এছাড়াও রাতের বেলায় খাওয়ার পর ব্রাশ করে নেওয়া উত্তম।
✓ কিডনির সমস্যা রয়েছে অথবা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ডাইউরেটিক্স (Diuretics) গ্রুপের ওষুধ খাচ্ছেন এমন ব্যক্তিদের জন্য আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়া ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আপেল ভিনেগার দাম কত?
বাজারে ৭০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যেই ১ লিটার আপেল সিডার ভিনেগার পাওয়া যায়। তবে ব্র্যান্ড ভেদে দাম আরো কম বেশি হতে পারে।
বাজার থেকে কেনার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন অরগানিক অর্থাৎ ফিল্টার না করা যথা মাদার সমৃদ্ধ আপেল সাইডার ভিনেগারটি আপনি কিনছেন।
আপেল ভিনেগার তৈরির নিয়ম
আজকাল বাজারে অনেক ভেজাল আপেল ভিনেগার পাওয়া যাচ্ছে। নিজে নিজে বাসা বাড়িতে বানিয়ে খাওয়া সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকরী। প্রস্তুত প্রণালী নিম্নরূপঃ
প্রয়োজনীয় উপকরণঃ
- কাঁচের জার
- কয়েকটি আপেল
- চিনি ও পানি
প্রক্রিয়াঃ
প্রথমে আপেল গুলো ধুয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে তা একটি কাঁচের জারে রাখুন। এবার পরিমাণ মতো পানি নিয়ে তাতে কয়েক চামচ চিনি গুলিয়ে সেই পানি জারের মধ্যে ঢালুন যেন তা আপেলের ১ ইঞ্চি উপর পর্যন্ত থাকে। জারের মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখুন ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত। অতঃপর ছেঁকে নিয়ে পুনরায় কিছু চিনি মিশিয়ে ১ আবার সপ্তাহ রেখে দিন। ১ সপ্তাহ ব্যবহার উপযোগী হবে।
References
Shubrook, N. (2021, 8 16). Top 5 benefits of apple cider vinegar. From bbc good food: https://www.bbcgoodfood.com/howto/guide/health-benefits-apple-cider-vinegar/amp
Wong, C. (2022, 03 09). The Health Benefits of Apple Cider Vinegar. From verywellhealth: https://www.verywellhealth.com/apple-cider-vinegar-88768#toc-dose-and-preparation
Last Updated on April 16, 2023
Leave A Comment