মানব দেহের প্রায় ৭৫ শতাংশ হলো পানি। দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে শারীরবৃত্তীয় সকল কাজে পানির প্রয়োজন হয়। পানি শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করতে সাহায্য করে। আর তাই প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা উচিত।
তবে ঠান্ডা পানি পান করার চাইতে কুসুম গরম পানি খাওয়ার উপকারিতা অনেক বেশি। এই অনুচ্ছেদ থেকে গরম পানি খাওয়ার উপকারিতা ও গরম পানি খাওয়ার ক্ষতিকর দিক সহ গরম পানি মাথায় দিলে কি হয় তা জানতে পারবেন।
Table of Contents
গরম পানি খাওয়ার উপকারিতা
১. হজম শক্তি বৃদ্ধি করে
খাবার ঠিকমত হজম না হলে পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব, পেট ফাঁপা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। হজমের সমস্যা হলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই সুস্থ থাকার জন্য হজম শক্তি ঠিক রাখা জরুরী। খাদ্য গ্রহণের পর ঠাণ্ডা পানি পান করলে খাদ্যের সাথে থাকা চর্বিগুলো জমে যায়। এতে পাকস্থলীতে চর্বির স্তর জমতে থাকে যা পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে।
কিন্তু গরম পানি পান করলে চর্বি ভেঙ্গে যায়, ফলে সহজেই চর্বি হজম বা নিঃসরণ হয়। গরম পানির ভ্যাসোডাইলেটর ফ্যাক্টর রয়েছে। অর্থাৎ গরম পানি রক্তনালীকে প্রশস্ত করে এবং রক্ত প্রবাহকে অন্ত্রের দিকে অগ্রসর করে যা পরিপাক প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে থাকে।
২. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার উপায়
কোষ্ঠকাঠিন্য যন্ত্রণাদায়ক একটি সমস্যা। যদি সপ্তাহে তিনবারের কম পায়খানা হয় অথবা মলত্যাগ করতে গেলে ভীষণ কষ্ট লাগে তাহলে তাকে কোষ্ঠকাঠিন্য বলা হয়। গরম পানি পান করলে পাকস্থলীর কার্যক্ষমতা তথা হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও গরম পানি অন্ত্র (Intestine) এর গতি ভালো রাখে যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়তা করে। প্রতিদিন খালিপেটে কুসুম গরম পানি পান করলে এটি পায়খানার বেগ পেতে সাহায্য করে, যার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়ে যায়।
৩. বন্ধ নাক খোলার উপায়
শীতকালে অনেকেরই সর্দি কাশি লেগেই থাকে। শীতকালের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা হলো ঠাণ্ডা লেগে নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া। গরম পানি শ্বাসনালীর সংক্রমণ দূর করতে সহায়তা করে। ঠান্ডা পানির চেয়ে গরম পানি পান করলে নাক বন্ধ হওয়ার সমস্যা থেকে দ্রুত মুক্তি পাওয়া যায়, কারণ উচ্চ তাপমাত্রা মিউকাস চলাচলের গতিকে বৃদ্ধি করে। গরম পানির ভাপ নেওয়ার মাধ্যমে নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৪. শরীর ব্যথা দূর করে
গরম পানি পান করলে শরীরে রক্ত প্রবাহ বেড়ে যায়। যার ফলে পেশি শিথিল হয় এবং ব্যথা কমে যায়। গরম পানি শরীরের প্রায় সকল প্রকার ব্যথা দূর করতে সাহায্য করে। বাহ্যিকভাবে ব্যথার স্থানে গরম পানি বোতলে ভরে সেঁক দিলে উপকার পাওয়া যায়। এছাড়াও গলা ব্যথা দূর করতে গরম পানিতে অল্প পরিমাণে লবণ মিশিয়ে গড়গড়া করা বহুল প্রচলিত একটি পদ্ধতি।
৫. মাসিকের ব্যাথা দূর করে
অনেক মেয়েরই অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যা আছে। আবার অধিকাংশ মেয়েদের মাসিকের সময় প্রচণ্ড ব্যাথা হয়ে থাকে, যা সহ্য করা অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ে।
গরম পানি পান করলে পিরিয়ডের ব্যথা অনেকটাই কমে যায়। এছাড়াও গরম পানি প্লাস্টিকের বোতলে ভরে তলপেটে সেঁক দিলে মাসিকের ব্লিডিং ভালো ভাবে হয় এবং তুলনামূলক ব্যথার মাত্রা কম থাকে।
৬. শরীরের বর্জ্য বের করে দেয়
ঘামের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বর্জ্য পদার্থ বাইরে বেরিয়ে আসে। গরম পানি পান করলে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ে, ফলে আরো বেশি ঘাম হয় এবং এভাবে শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের হয়ে যায়।
৭. ওজন কমানোর উপায়
শরীরের অতিরিক্ত ওজন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় কারণ তা বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। সুস্বাস্থ্যের জন্য তো বটেই, শারীরিক সৌন্দর্যের জন্যও নারী-পুরুষ উভয়েরই শরীরের ওজন ঠিক রাখা প্রয়োজন। গরম পানি পান করলে ওজন কমে না, কিন্তু তা ওজন কমানোর প্রক্রিয়াকে সাহায্য করে।
গরম পানি পান করলে বিপাক প্রক্রিয়া ভাল হয়। প্রতিদিন সকালে খালিপেটে গরম পানি ও লেবু খাওয়ার অভ্যাস করুন। যা শরীরকে কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করবে এবং শরীর থেকে ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দেবে। সেই সাথে ক্ষুধা বোধ কমানোর মাধ্যমে ওজন কমাতে সহায়তা করবে।
৮. রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে
গরম পানি পান করলে তা শরীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। ফলে পেশী ও স্নায়ু সঠিক ভাবে কাজ করতে পারে। পেশির সঞ্চালন ও স্নায়ুর সঠিক কর্মকাণ্ডের জন্য গরম পানি পান করা প্রয়োজন। এছাড়াও কুসুম গরম পানিতে গোসলের মাধ্যমে শরীরের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া এবং স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রম ভালো থাকে।
৯. ঘুমের সমস্যা দূর করার উপায়
ঘুম না হওয়া সমস্যাটি খুব কমন ১টি ব্যাপার। ঘুমের ব্যাঘাত হলে মন এবং শরীরের উপর প্রভাব পড়ে, ফলে কোনো কাজই ঠিকভাবে করা হয় না। ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে গরম পানি পান করলে প্রশান্তি পাওয়া যায়, যা দ্রুত ঘুমিয়ে যেতে সহায়তা করে এবং পেট ভরা আছে এমন অনুভূতি দেয় যা মধ্যরাতে ক্ষুধা জাগ্রত করে না। এছাড়াও সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে হালকা গরম পানিতে গোসল করে নেওয়ার মাধ্যমে বেশ উপকারিতা পাওয়া যায়।
১০. অকালে বয়সের ছাপ দূর করবে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের ত্বকে বয়সের ছাপ পড়ে যায় এবং ত্বকে নানান সমস্যা দেখা দেয়। ফলে চামড়া কুঁচকে যায়, ভাজ পড়ে বা ঝুলে যায় যা বলিরেখা বা বয়সের ছাপ হিসেবে পরিচিত। গরম পানি পান করলে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে। ফলে ঘাম বেশী হয়। ঘামের সাথেই শরীরের অনেক ধরনের বর্জ্য বের হয়ে যায়। এতে ত্বক ভালো থাকে।
শরীরের বর্জ্য বের না হলে ত্বকের কোষ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে অকালে বয়সের ছাপ পড়ে। গরম পানি এই নষ্ট কোষগুলোকে ঠিক করে ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়। ফলে ত্বক কোমল হয় এবং বয়সের ছাপ দূর হয়।
গরম পানি খাওয়ার ক্ষতিকর দিক
গরম পানি খাওয়ার তেমন কোনো ক্ষতিকর দিক নেই বললেই চলে। তবে খুব বেশি গরম পানি পান করার ফলে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। যেমনঃ (Watson, 2020)
- জিহ্বার উপরিভাগে থাকা টেস্টবাডস (Taste buds) গুলো পুড়ে যায় যার ফলে জিহ্বায় খাবারের স্বাদ বোঝা যায় না
- ঠোঁট, মুখের ভেতরের অংশ ও খাদ্যনালী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
গরম পানি খেলে কি গ্যাস হয়?
গরম পানি পান করার সাথে পেটে গ্যাস হওয়ার কোনো যোগসূত্র নেই। তবে কারো ক্ষেত্রে এমনটি মনে হলে সেক্ষেত্রে আগে নিশ্চিত হতে হবে যে, অন্য কোনো কারণে গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে কিনা। সাধারণত অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং অনিয়মিত জীবন যাপনের ফলে গ্যাসের সমস্যা হয়। তবে এর বাইরেও কারো ক্ষেত্রে যদি গরম পানি পান করার দরুন গ্যাসের সমস্যা হয়, সেক্ষেত্রে তার জন্য গরম পানি না খাওয়াই ভালো।
গরম পানি দিয়ে মুখ ধোয়ার উপকারিতা
গরম পানি দিয়ে মুখ ধোয়ার মাধ্যমে ময়লা ও মৃত কোষ দূর হয়। এছাড়াও মুখের অতিরিক্ত তেল ভাব ও ব্রণ হওয়ার প্রবণতা কমে যায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন, পানি একদম কুসুম গরম প্রকৃতির হয়।
শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় মুখের ত্বক বেশি কোমল। আর তাই অতিরিক্ত গরম পানি দিলে তা ত্বকের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
গরম পানি মাথায় দিলে কি হয়?
গরম পানি মাথায় দিলে ত্বক পরিষ্কার হবে একথা সত্যি কিন্তু পানি খুব বেশি গরম হলে মাথার ত্বক ও চুলের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। বিশেষত চুল রুক্ষ প্রকৃতির হয় এবং সহজেই ভেঙে যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে- গোসলের শুরুতে কুসুম গরম পানি দিয়ে মাথা পরিষ্কার করে তারপর ঠান্ডা পানি ঢেলে গোসল শেষ করা। (Gupta, 2019)
গরম পানি করার অনেক উপকারিতা রয়েছে তবে এর জন্য অবশ্যই কুসুম গরম পানি পরিমিত মাত্রায় পান করতে হবে। আবার শরীরে খুব বেশি পানিশূন্যতা হলে সেক্ষেত্রে গরম পানি না খেয়ে বরং স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি বা ঠান্ডা পানি পান করা ভালো হবে বিশেষত গরমের দিনে অথবা খুব বেশি ক্লান্ত হওয়ার পর।
References
Gupta, A. (2019, 07 13). Here is why you should not wash your hair with hot water. Retrieved from timesnownews: https://www.timesnownews.com/health/article/here-is-why-you-should-not-wash-your-hair-with-hot-water/453222
Watson, K. (2020, 11 4). What Are the Benefits of Drinking Hot Water? Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/benefits-of-drinking-hot-water
Last Updated on April 12, 2023
Leave A Comment