কিটোজেনিক ডায়েট বা সংক্ষেপে কিটো ডায়েট (Keto diet) বর্তমান সময়ে খুব জনপ্রিয় একটি বিষয় হয়ে উঠেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে শরীরের ওজন কমানোর জন্য কিটো ডায়েট পালন করার প্রচলন দেখা যায়। কিন্তু সবার জন্য কিটো ডায়েট পালন করা নিরাপদ হবে কিনা সেই বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা উচিত।
মহিলাদের ক্ষেত্রে শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য কিটো ডায়েট কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে কিনা, ওজন কমানো ব্যতীত কিটো ডায়েটের কি কি উপকারিতা রয়েছে এবং কিটো ডায়েট পালনের ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
কিটো ডায়েট
সহজ ভাষায় কিটো ডায়েট বলতে বোঝায় খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণ ফ্যাট জাতীয় খাবার রাখা এবং কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ অত্যন্ত কম হওয়া।
শরীরের সকল কার্যক্রমের জন্য ক্যালরি বা শক্তি দরকার হয় যা কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট জাতীয় খাবার থেকে পাওয়া যায়।
দৈনিক ক্যালরি চাহিদার ৪৫ থেকে ৬০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার, ১০ থেকে ২৫ শতাংশ প্রোটিন জাতীয় খাবার এবং ৩০ শতাংশ ফ্যাট জাতীয় খাবার থেকে গ্রহণ করা আদর্শ খাদ্যাভ্যাস হিসেবে ধরা হয়।
কিটো ডায়েটের ক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কমিয়ে ফ্যাটের পরিমাণ বাড়ানো হয়। এক্ষেত্রে দৈনিক ক্যালরি চাহিদার ৭০ শতাংশ ফ্যাট, ২০ শতাংশ প্রোটিন ও ১০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার থেকে গ্রহণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। (Mawer, 2023)
উচ্চ প্রোটিনযুক্ত কিটো ডায়েটের ক্ষেত্রে মাত্র ৫ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ৩৫ শতাংশ প্রোটিন ও ৬৫ শতাংশ ফ্যাট গ্রহণ করা হয়।
মূলত কিটো ডায়েট হলো ফ্যাট নির্ভর খাদ্যাভ্যাস যেখানে খাদ্যতালিকার সবচেয়ে বড় অংশ (দৈনিক ক্যালরি চাহিদার ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ) জুড়ে থাকে ফ্যাট জাতীয় খাবার আর সবচেয়ে কম পরিমাণে (দৈনিক ক্যালরি চাহিদার মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ) কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার থাকে।
কিটো ডায়েটের খাবার
যা যা খেতে হবে
- মাছ ও সামুদ্রিক খাবার
- মুরগি ও গরুর মাংস
- ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
- বাদাম, বীজ ও শস্যদানা
- অ্যাভোকাডো ও টমেটো
- এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল
- নারিকেল তেল ও সূর্যমুখী তেল
- শাকসবজি ও টকজাতীয় ফল
খাওয়া যাবে না
- ভাত ও রুটি (খেলেও খুব সামান্য)
- নুডুলস, পাস্তা, পাউরুটি ও বিস্কুট
- চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার
- আইসক্রিম ও কোমল পানীয়
- ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার
- মিষ্টিজাতীয় ফল ও ফলের জুস
মহিলাদের জন্য কিটো ডায়েট এবং ওজন হ্রাস
সাধারণত কার্বোহাইড্রেট ভেঙে গ্লুকোজ হয় যা থেকে মেটাবলিসমের মাধ্যমে ক্যালরি উৎপন্ন হয়ে থাকে। কিটো ডায়েটের ক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ খুব কম থাকে। যার ফলে মেটাবলিসমের ধরন পরিবর্তন হয়ে ফ্যাট জাতীয় খাবার থেকে ক্যালরি উৎপাদন হতে থাকে। এতে শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত ফ্যাট ভেঙে ক্যালরি উৎপন্ন হয় যা শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, মহিলাদের ক্ষেত্রে শরীরের অতিরিক্ত ফ্যাট বা ওজন কমানোর জন্য কিটো ডায়েট পালন করা বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। (Richter, 2020)
ওজন কমাতে কিটো ডায়েট উপকারী হলেও এর দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল কেমন হবে সেই বিষয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। তাই ওজন কমানোর জন্য চিকিৎসকেরা কিটো ডায়েট পালনে নিরুৎসাহিত করে থাকেন।
মহিলাদের জন্য কিটো ডায়েট এবং রক্তে সুগার নিয়ন্ত্রণ
কিটো ডায়েটে কম পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার থাকে। তাই রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কিটো ডায়েট পালন করা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে কিটো ডায়েট পালন করার ফলে HbA1c এর মাত্রা কমে গেছে। HbA1c হলো রক্তে সুগারের গড় মাত্রা পরিমাপের একটি টেস্ট। (Richter, 2020)
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কিটো ডায়েটের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার বিষয়ে গবেষণার ঘাটতি রয়েছে।
কিটো ডায়েটের প্রভাবে রক্তে সুগারের মাত্রা একদম কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া (Hypoglycemia) হতে পারে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য কিটো ডায়েট পালন করা উচিত হবে না।
মহিলাদের ক্যান্সারের চিকিৎসায় কিটো ডায়েটের কার্যকারিতা
গবেষণায় দেখা গেছে যে, মহিলাদের ক্ষেত্রে জরায়ু ও ওভারি ক্যান্সার সহ পলিসিস্টিক ওভারী সিনড্রোম (পিসিওএস) নিরাময়ের জন্য কিটো ডায়েট সহায়ক ভূমিকা পালন করে। (Richter, 2020)
তবে ক্যান্সার প্রতিরোধ বা চিকিৎসা ক্ষেত্রে সহায়তা হিসেবে কিটো ডায়েট পালন করা উচিত হবে কিনা এই বিষয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। এছাড়াও ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য কতদিন ধরে কিটো ডায়েট পালন করতে হবে সেই বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই।
ক্যান্সারের চিকিৎসায় সহায়তা হিসেবে কিটো ডায়েট পালন করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে।
কিটোজেনিক ডায়েট কি মহিলাদের জন্য কোনো ঝুঁকি তৈরি করতে পারে?
হার্টের জন্য ক্ষতিকর
কিটো ডায়েটে ফ্যাট জাতীয় খাবারের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে যা রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা (LDL- low density lipoprotein) বাড়িয়ে দিতে পারে। আর রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে হার্টের রোগে (হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
কিডনির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে
অতিরিক্ত প্রোটিন ও ফ্যাট জাতীয় খাবার থেকে তৈরি হওয়া বর্জ্য কিডনির মাধ্যমে ছেঁকে শরীর থেকে বের করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এছাড়াও শরীরে পানি স্বল্পতা সৃষ্টি সহ কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
কোষ্ঠকাঠিন্য
কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার খুব কম গ্রহণ করা হয় বলে শরীরে ফাইবারের ঘাটতি হয়। ফ্যাট ও প্রোটিন জাতীয় খাবারে তেমন ফাইবার থাকে না বললেই চলে। যার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা যায়। আর দীর্ঘমেয়াদী কোষ্ঠকাঠিন্যের ফলে পাইলস (Hemorrhoids) হতে পারে।
ব্যয়বহুল
কিটো ডায়েটের খাদ্য উপকরণগুলো ব্যয়বহুল হয়ে থাকে। এছাড়াও এই ধরনের ডায়েট মেনে চলার জন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে একত্রে রান্না ও খাওয়া সম্ভব হয় না।
অন্যান্য
- শরীরে ভিটামিন, মিনারেল ও এন্টি-অক্সিডেন্ট এর ঘাটতি দেখা দেয়।
- লিভারে ফ্যাট জমা হওয়া এবং পিত্তথলিতে পাথর হতে পারে।
- প্যানক্রিয়াস ও থাইরয়েডের গ্রন্থির সমস্যা হতে পারে।
- অতিরিক্ত চুল পড়ে (Hair falling) যেতে পারে।
- ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
শেষ কথা
মহিলাদের ক্ষেত্রে শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানো, রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, পলিসিস্টিক ওভারি ডিজিজ সহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য কিটো ডায়েট সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
তবে কিটো ডায়েটের কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে। তাই কিটো ডায়েট শুরু করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
গর্ভধারণে ইচ্ছুক, গর্ভবতী নারী, স্তন্যদানকারী মা, কিডনি বা লিভারের সমস্যা রয়েছে এমন নারীদের জন্য কিটো ডায়েট করা যাবে না।
References
Mawer, R. (2023, June 28). The Ketogenic Diet: A Detailed Beginner’s Guide to Keto. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/ketogenic-diet-101
Richter, A. (2020, April 17). Is the Ketogenic Diet Effective for Women? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/keto-for-women
Last Updated on January 1, 2024
Leave A Comment