গর্ভকালীন সময়ে মহিলাদের অনেক ধরণের শারীরিক পরিবর্তন হয়। নতুন নতুন অনেকেই ব্যাপারগুলো বুঝে উঠতে পারে না। কারণ প্রেগনেন্সি বিষয়ে সঠিক জ্ঞান রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে অনেকেই উদাসীন। গর্ভধারনের প্রথম কয়েক মাস মা ও শিশু দুজনের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভবতী হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ, গর্ভধারনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রকাশ পায়।
এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে, তা গর্ভাবস্থায় মা এবং শিশু উভয়ের স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তাই গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখা বিবাহিত, অবিবাহিত প্রত্যেক নারী, এবং তাদের পরিবারের মানুষজনের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
Table of Contents
গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণসমূহ
আপনি গর্ভবতী হয়েছেন কিনা তা নিশ্চিত করে বোঝার জন্য প্রেগনেন্সি টেস্ট করার প্রয়োজন। তবে গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ দেখে প্রেগনেন্সি টেস্ট ছাড়াও তা অনুমান করা যায়। গর্ভবতী হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণগুলো এখানে আলোচনা করা হল।
গর্ভবতী হওয়ার ১৪টি প্রাথমিক লক্ষণ
১. Missed Period (বিলম্বিত মাসিক)
মাসিকের সময় পার হয়ে যাওয়া গর্ভবতী হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে একটি । যাইহোক, সবসময় মাসিক বিলম্বিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে আপনি গর্ভবতী, বিশেষ করে যদি আপনার আগে থেকেই অনিয়মিত পিরিয়ড হয়ে থাকে।
২. মাথা ব্যথা
গর্ভবতী হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে মাথা ব্যাথা অন্যতম। সাধারণত এসময় হরমোনের মাত্রার অতিরিক্ত পরিবর্তন এর কারণে মাথা ব্যাথা হয়।
৩. রক্তপাত
কিছু নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভবতী হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে হালকা রক্তপাত হতে পারে। জরায়ুর আস্তরণের সাথে নিষিক্ত ডিম্বানুর সংযুক্তি বা ইমপ্লান্টেশনের (Implantation) সময় এই রক্তপাত হয়। সাধারণত গর্ভবতী হওয়ার এক থেকে দুই সপ্তাহ এর মধ্যে ইমপ্লেন্টেশন হয়। এছাড়াও এটি হরমোন বৃদ্ধি বা জরায়ু ক্র্যাম্পিং এর ফলেও হতে পারে।
রক্তপাত কখনও কখনও গর্ভাবস্থার গুরুতর জটিলতার সংকেত দিতে পারে, যেমন গর্ভপাত, এক্টোপিক প্রেগনেন্সি (জরায়ু ছাড়া অন্য কোথাও ডিম্বানু নিষিক্তকরন)। তাই, রক্তপাতের বিষয়টি হালকা ভাবে না নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
৪. ওজন বৃদ্ধি
গর্ভাবস্থার প্রথম কয়েক মাসে যে কোন নারীর ওজন ২ থেকে ৪ কেজি বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক এর (Second Trimester) শুরুতে ওজন বৃদ্ধি আরও লক্ষণীয় হয়ে ওঠে।
৫. উচ্চ রক্তচাপ
গর্ভবতী হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ এর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ অন্যতম। গর্ভাবস্থায় বেশ কয়েকটি কারণ আপনার উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে:
- ওজন বৃদ্ধি বা স্থূলকায় হওয়া
- ধূমপান
৬. গলায় জ্বালাপোড়া করা
প্রেগন্যান্সির লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মহিলাদের শরীরে হরমোনের অনেক তারতম্য হয় এবং স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হরমোন নির্গত হয়।
নির্গত এই হরমোনগুলো কখনও কখনও খাদ্যনালীর মাধমে পেটের ভিতরে প্রবেশ করে। হরমোনগুলো পেটের ভিতরে প্রবেশ করার পর পাকস্থলী থেকে কিছু পরিমাণ এসিড নিঃসৃত হয়।এই এসিডের ঝাঁঝ যখন খাদ্যনালীতে এসে লাগে, তখন গলায় জ্বালাপোড়া করে।
৭. কোষ্ঠকাঠিন্য
গর্ভবতী হওয়ার বিভিন্ন লক্ষণ এর প্রভাবে কয়েক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়। নিঃসৃত হওয়া এই হরমোনগুলো হজম প্রক্রিয়ার গতিকে ধীর করে দেয়। হজম প্রক্রিয়ার এ ধীর গতির জন্য গর্ভাবস্থায় সময়মত টয়লেট হয় না, এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও অনুভূত হয়।
৮. পেট ব্যাথা
গর্ভকালীন সময়ে জরায়ুর পেশীগুলি প্রসারিত হওয়ার কারণে পেটে একটি টান অনুভব হতে পারে যা সাধারণত মেয়েদের মাসিকের সময় হয়ে থাকে। যদি ব্যাথার পাশাপাশি রক্তপাত হয়, তবে এটি গর্ভপাত বা জটিল গর্ভাবস্থার সংকেত দিতে পারে। সেক্ষেত্রে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
৯. রক্তশূন্যতা
রক্তশূন্যতা গর্ভবতী মহিলাদের জন্য একটি সাধারণ সমস্যা। কারন গর্ভাবস্থাকালীন সময়ে শিশুর বুদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রচুর পরিমাণে লোহিত রক্তকণিকার প্রয়োজন হয় এবং লোহিত রক্তকণিকার এ চাহিদা মায়ের রক্ত থেকেই পূরণ হয়। তাই গর্ভবতী মহিলাদের রক্তশূন্যতার ঝুঁকি বেশি থাকে, যার ফলে মাথা ব্যথা এবং মাথা ঘোরা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। রক্তশূন্যতার কারণে অপরিপক্ক সন্তান জন্মের সম্ভাবনা থাকে।
১০. বিষন্নতা
১৪-২৩ শতাংশ গর্ভবতী নারীই বিষন্নতায় ভোগেন। গর্ভাবস্থায় হরমোনের অধিক তারতম্য এ বিষন্নতার জন্য দায়ী। তাই এসময় নারীদের মুড খুব দ্রুত সুইং করতে দেখা যায়, যেমন এই হাসি, হঠাত কান্না, মন খারাপ করে থাকা, খিটখিটে মেজাজ করা ইত্যাদি।
১১. অনিদ্রা
অনিদ্রা গর্ভবতী হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ গুলোর মধ্যে একটি। মানসিক চাপ, শারীরিক অস্বস্তি এবং হরমোনের পরিবর্তন এসময় ঘুম না হওয়ার প্রধান কারণ। গর্ভবতী মহিলারা ভালো ঘুমের জন্য সুষম খাদ্য, সঠিক সময়ে ঘুমের অভ্যেস এবং নিয়মিত যোগব্যায়াম করতে পারেন।
১২. স্তনের পরিবর্তন
স্তনের পরিবর্তন গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ গুলোর মধ্যে একটি। যেমন স্তন ফুলে যাওয়া এবং ভারী ভারী বা পূর্ণ বোধ করা। এছাড়াও এসময় স্তনবৃন্ত বড় এবং আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে। এসময় প্রজেস্টেরনের (progesterone) এবং ইস্ট্রোজেনের (Estrogen) মতো হরমোন বাড়ার কারণে স্তনের কোমলতা বৃদ্ধি পায়।
১৩. ব্রণ
এন্ড্রোজেন (Androgen) হরমোন বৃদ্ধির কারণে, অনেক মহিলারই গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে ব্রণ হয়। কারণ এই হরমোনগুলি ত্বককে তৈলাক্ত করে লোমকূপ আটকে দেয়। তবে এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, কারণ গর্ভাবস্থায় ব্রণ সাধারণত সাময়িক এবং শিশুর জন্মের পর ভাল হয়ে যায়।
১৪. বমি
বমি ভাব এসময়ের খুব সাধারণ একটি লক্ষণ। সাধারণত প্রথম চার মাস জুড়ে এই লক্ষণ দেখা যায়। শরীরের হরমোন বৃদ্ধি এর প্রধান কারণ। এতো গেল, গর্ভবতী সময়ের সাধারণ লক্ষণ সমূহ। এবার চলুন দেখে নেয়া যাক, সময় ভেদে লক্ষণ গুলো কেমন হয়ে থাকে।
গর্ভবতী হওয়ার প্রথম সপ্তাহের লক্ষণ সমূহ
গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণগুলো যত সময় বাড়ে ততই বেশি পরিলক্ষিত হয় এবং সময়ের সাথে সাথে এ লক্ষণগুলোর কিছুটা পরিবর্তনও দেখা যায়। যেমন প্রথম সপ্তাহের লক্ষণ সমূহ এর সাথে প্রথম মাসের লক্ষণ এর ব্যাপক পরিবর্তন রয়েছে।
প্রেগন্যান্সির প্রথম সপ্তাহের লক্ষণ সমূহ নিম্নরূপ:
- এর মধ্যে প্রধান লক্ষণ হল বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
- স্তন এর পরিবর্তন । যেমন: কোমলতা বৃদ্ধি পাওয়া, ফুলে যাওয়া, শিরা-উপশিরা দৃশ্যমান হওয়া ইত্যাদি
- ঘন ঘন প্রস্রাব
- মাথা ব্যাথা
- শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া
- বিরক্তি বা মেজাজ পরিবর্তন
- খাবারের প্রতি অনীহা
- তীব্র গন্ধের অনুভূতি ইত্যাদি গর্ভবতী হওয়ার প্রথম সপ্তাহের লক্ষণ সমূহ এর মধ্যে অন্যতম।
গর্ভবতী হওয়ার প্রথম মাসের লক্ষণ
গর্ভবতী হওয়ার প্রথম মাসের লক্ষণ খুব বেশি প্রকাশের সম্ভাবনা থাকে না। তবে এই নয় যে প্রথম মাসটি উপসর্গহীন।
প্রেগন্যান্সির বা গর্ভবতী হওয়ার প্রথম মাসের লক্ষণ সমূহ নিম্নরূপ:
১. ক্লান্তি
সন্তান জন্মদানের জন্য একজন মায়ের প্রায় ১০ মাস অপেক্ষা করতে হয়। এই পুরো সময়টা একটি শরীরে দুজনের উপস্থিতি থাকে। যার কারণে শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন সিস্টেম কে বেশি বেশি কাজ করতে হয়, যা একজন গর্ভবতী মায়ের শরীরকে ক্লান্ত করে দেয়।
২. স্তনের পরিবর্তন
৩. ক্র্যাম্পিং এবং পেটে ব্যথা: যা জরায়ুর পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে।
৪. ঘন ঘন প্রস্রাব করা
গর্ভবতী হওয়ার প্রথম মাসেই প্রোজেস্টেরন ও হিউম্যান করিওনিক গোনাডোট্রপিন (HCG) হরমোন নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। আমরা সারাদিন যে পানি পান করি, এই হরমোন দুটি সেই পানি কিডনীর মাধ্যমে পরিশোষণ করে প্রস্রাবে পরিণত করে।
যেহেতু গর্ভবতী মহিলাদের প্রোজেস্টেরন ও হিউম্যান করিওনিক হরমোন উভয়ই রৃদ্ধি পায় তাই প্রস্রাবও বেশি পরিমাণে তৈরি হয়। তাই এসময় ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ পায়।
৫. রক্তপাত
গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ কত দিন পর বোঝা যায়
গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণগুলি সাধারণত পিরিয়ড মিস হওয়ার পর থেকে বোঝা যায়। অর্থাৎ, গর্ভধারণের ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর। তবে, অনেক ক্ষেত্রে পিরিয়ড মিস হওয়ার আগেইও কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন, বমি বমি ভাব, স্তনে ব্যথা, ক্লান্তি, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি।
নির্ভরযোগ্যভাবে গর্ভধারণের লক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য প্রেগন্যান্সি টেস্ট করার বিকল্প নেই। গর্ভধারণের ৭ থেকে ১৪ দিন পর প্রেগন্যান্সি টেস্ট করা যেতে পারে।
মেয়েরা কিভাবে গর্ভবতী হয়?
মেয়েরা কিভাবে গর্ভবতী হয় এ কথার উত্তর এক কথায় দিতে চাইলে বলা যায়, জরায়ুর মধ্যে একটি নিষিক্ত ডিম্বাণু প্রতিস্থাপিত হলে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়েরা গর্ভবতী হয়। অর্থাৎ যখন একটি শুক্রাণু গর্ভাশয় থেকে নির্গত হয়ে একটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে তখনই একজন নারীর গর্ভাবস্থা সংঘটিত হয়। (Parenthood, 2020) শুক্রানু ও ডিম্বানুর মিলনের এ প্রক্রিয়াকে ফার্টিলাইজেশন (Fertilization) বলা হয়। ফার্টিলাইজেশনের পর নিষিক্ত ডিম্বাণু ফ্যালোপিয়ান টিউব (Fallopian Tube) থেকে জরায়ুর দিকে চলে যায়।
এটি ক্রমবর্ধমান কোষে বিভক্ত হতে শুরু করে, এবং একটি চাকতির ন্যায় আকার সৃষ্টি করে, যাকে বলা হয় ব্লাস্টোসিস্ট (Blastocyst) যা গর্ভধারনের প্রায় ৩-৪ দিন পর জরায়ুতে প্রবেশ করে এবং ২-৩ দিন পর্যন্ত এখানেই অবস্থান করে। ইমপ্লান্টেশন সাধারণত গর্ভাধানের প্রায় ৬ দিন পরে শুরু হয় এবং এটি সম্পন্ন হতে প্রায় ৩-৪ দিন সময় নেয়। যখন একটি নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুতে অবস্থান করে, তখন এটি কিছু হরমোন নিঃসরণ করে যা জরায়ুর আস্তরণকে ঝরে পড়া থেকে বিরত রাখে –
এজন্যই গর্ভবতী হলে পিরিয়ড হয় না। একজন মায়ের শরীরে গর্ভবতী হওয়ার এই প্রক্রিয়াগুলো শেষে প্রেগন্যান্ট হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেতে সহবাসের পর অন্তত ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। একটি পূর্ণ মেয়াদী গর্ভাবস্থা সাধারণত ৪০ সপ্তাহ স্থায়ী হয়।
গর্ভবতী হওয়ার পর কি মাসিক হয়?
অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন গর্ভবতী হওয়ার পর কি মাসিক হয়? সাধারণ একজন মহিলার গড়ে ২৮ দিন পর পর মাসিক হয়। মাসিক কত দিন হয়, তা নিয়ে অনেকেরই পরিষ্কার ধারণা নেই। সাধারণত মাসিক ১ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। বেশীরভাগ মহিলাদের তিন থেকে পাঁচ দিনের জন্য রক্তপাত হয়, তবে দুই দিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত সময়কালকে স্বাভাবিক বলে বিবেচিত করা হয়।
গর্ভকালীন সময়ে সাধারণত মেয়েদের মাসিক হয় না, তবে কিছু ক্ষেত্রে পিরিয়ডের মতই রক্তপাত হতে পারে । যেমন –
- হতে পারে ইমপ্লেন্টশনের রক্তপাত
- ইনফেকশন থাকলে
- এক্টোপিক (Ectopic pregnancy) প্রেগনেন্সি
- গর্ভপাত (Miscarriage)
- জরায়ুর স্তর ফেটে যাওয়া
পিরিয়ড কখন শুরু হয় এবং বন্ধ হয়?
বেশীরভাগ মেয়েদের ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে পিরিয়ড শুরু হয়, কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে আগ-পিছ হতে পারে। বেশীরভাগ মহিলাদের ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে তাদের পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায় – একে মেনোপজ (Menopause) বলা হয়। মানে একজন নারীর বয়স মোটামোটি ৫০ পার হয়ে গেলে মেনোপজ শুরু হয়ে যায় অর্থাৎ মাসিক বন্ধ হয়ে যায়
মাসিকের কত দিন পর সহবাস করলে সন্তান হয়
অপরিকল্পিত গর্ভধারন রোধে বা পরিকল্পিত গর্ভধারণের জন্য মাসিকের কত দিন পর সহবাস করলে সন্তান হয় তা জানা দরকার। একজন নারীর স্বাভাবিকভাবে ২৮-দিনের মাসিক চক্র হয়ে থাকে। পিরিয়ডের সপ্তম থেকে ২১ তম দিন পর্যন্ত সহবাস করলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বেশি। পিরিয়ডের বাকি দিনগুলো, অর্থাৎ প্রথম থেকে সপ্তম ও ২১ তম দিন থেকে পুনরায় পিরিয়ড শুরু হওয়ার দিন পর্যন্ত সহবাসের নিরাপদ সময় হিসেবে গন্য করা হয়। রক্তক্ষরণ শুরু হবার দিনকে পিরিয়ডের প্রথম দিন ধরেই কিন্তু উপরোক্ত হিসেব করা হয়ে থাকে।
সহবাসের কত দিন পর বাচ্চা পেটে আসে বা গর্ভবতী হয়
গর্ভধারণ সহবাসের তিন মিনিট পরেই হতে পারে অথবা পাঁচ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ইমপ্লান্টেশন (যখন নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর প্রাচীরের সাথে সংযুক্ত হয়) গর্ভধারনের পাঁচ থেকে ১০ দিন পরে হয় – যার অর্থ যৌন মিলনের ৫ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই পূর্ণরূপে গর্ভাবস্থা শুরু হয়। কিছু নারীর গর্ভাবস্থা শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই গর্ভাবস্থার লক্ষণ গুলি প্রকাশিত হতে থাকে আবার কিছু নারীর ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থার কয়েক মাসেও কোন লক্ষণ প্রকাশিত হয় না।
প্রেগন্যান্সি টেস্ট কত দিন পর করতে হয়?
গর্ভাবস্থা পরীক্ষার সব থেকে সঠিক সময় হল পিরিয়ড বা মাসিক মিস হওয়ার এক সপ্তাহ পর। প্রেগন্যান্সি টেস্ট নিয়মিত মাসিকের তারিখের সাথে প্রথম মিসড পিরিয়ডের প্রথম দিন হিসাবে করা যেতে পারে। যদি কারো অনিয়মিত পিরিয়ড থাকে, তাহলে সহবাসের ১৪ দিন পর একটি প্রেগনেন্সি টেস্ট করা যেতে পারে।
প্রেগন্যান্সি টেস্ট হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন (HCG- Human Chorionic Gonadotropin) নামে একটি হরমোন সনাক্ত করে, যা গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে উৎপাদিত হয়। এই হরমোনের উৎপাদন ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং গর্ভাবস্থা বাড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়। প্রস্রাব পরিক্ষা করে যদি তার মধ্যে ২০-৫০ মিলিয়ন/মিলিমিটার পরিমাণ হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন পাওয়া যায় তাহলে প্রেগনেন্সি টেস্ট পজিটিভ বলে ধরা হয়।
ঠিক কতদিন পর প্রেগন্যান্সি টেস্ট করতে হয়? যদি কেউ খুব শীঘ্রই প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে (সহবাসের পর পরই এবং পিরিয়ড মিস করার আগেই), HCG- এর মাত্রা গর্ভাবস্থা সনাক্ত করার জন্য যথেষ্ট মাত্রায় নাও হতে পারে এবং এটি একটি নেতিবাচক ফলাফলের কারণ হতে পারে, যদিও তিনি গর্ভবতী থাকেন। তাই একটি সাধারণ পরামর্শ সবাইকে দেয়া হয় যে পিরিয়ড মিস করার পর অন্তত একদিন অপেক্ষা করার জন্য, তবে ৭ দিন অপেক্ষা করে টেস্ট করলে সঠিক ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে।
প্রেগন্যান্সি টেস্ট
একজন নারী গর্ভবতী কিনা তা নিশ্চিত করতে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করা হয়। প্রেগনেন্সি টেস্ট ২টি প্রাথমিক উপায়ে করা যায়:
- রক্তে বা প্রস্রাবে নারীর গর্ভাবস্থার হরমোন হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন (HCG) এবং
- আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা।
Human Chorionic Gonadotropin (HCG) এর মাত্রা পরিমাপ করে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করা হয়। একে গর্ভাবস্থার হরমোন হিসাবেও উল্লেখ করা হয়, ইমপ্লান্টেশনের সময় এই হরমোন উৎপন্ন হয়। পিরিয়ড মিস হওয়ার পর, প্রস্রাবে এইচসিজির মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তখন প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে এইচসিজি সনাক্ত করা হয়।
রক্তে Human Chorionic Gonadotropin এর মাত্রা পরিমাপ করেও প্রেগন্যান্সি টেস্ট করা যায়। পার্থক্য হল ডিম্বস্ফোটনের (ovulation) ছয়-আট দিন পর রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। প্রথম ছয়-আট দিন পর রক্ত পরিক্ষা করে যদি রক্তে এইচসিজি এর মাত্রা ৫-৭২ এমআইইউ/এমএল (mIU/ml) পাওয়া যায় তাহলে প্রেগনেন্সি টেস্ট পজিটিভ ধরা হয়। ব্লাড টেস্টের মাধ্যমে অনেক কম মাত্রার HCG ও শনাক্ত করা যায়।
একজন মহিলা প্রেগনেন্ট কিনা তা আল্ট্রাসনোগ্রাফি টেস্ট এর মাধ্যমে পুরোপুরো নিশ্চিত হওয়া যায়। কারন এর মাধ্যমে পেটের বাচ্চার হার্টবিট, নড়াচড়া, বাচ্চা কোন পজিশনে আছে তা জানা যায়।
যত তাড়াতাড়ি আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন যে আপনি গর্ভবতী, ততই ভালো। প্রেগন্যান্সির লক্ষণ নির্ণয় আপনাকে আপনার শিশুর স্বাস্থ্যের আরও ভাল যত্ন নেওয়ার সুযোগ প্রদান করবে।
গর্ভাবস্থা বা পিএমএস
গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ প্রায়ই প্রি-মেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম (পিএমএস) এর মত হতে পারে। তাই এটা বোঝা কঠিন যে আপনার কি মাসিক শুরু হতে যাচ্ছে নাকি গর্ভবতী হতে চলেছেন।
একজন মহিলার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গর্ভবতী কিনা তা জানা জরুরী যাতে সে সঠিক প্রসবপূর্ব যত্ন পেতে পারে। এতে করে একজন গর্ভবতী নারী জীবন ধারার কিছু পরিবর্তন আনতে পারেন যেমন অ্যালকোহল, সিগারেট থেকে বিরত থাকা, প্রসবপূর্ব ভিটামিন গ্রহণ ইতাদি । পিএমএস বা প্রতি মাসে মাসিক শুরু হওয়ার আগে এবং প্রাথমিক গর্ভাবস্থা উভয়ের কিছু কমন লক্ষণ রয়েছে। যেমন-
- স্তন ব্যথা
- রক্তপাত
- মেজাজ পরিবর্তন
- ক্লান্তি
- খাদ্য সংবেদনশীলতা
- পেটেব্যথা
গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ এবং পিএমএস প্রায়ই আলাদা করা কঠিন।
গর্ভাবস্থা এবং যোনি স্রাব
যোনি স্রাব বৃদ্ধি গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ গুলির মধ্যে একটি। স্রাবের উৎপাদন গর্ভধারণের এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে বাড়তে পারে, এমনকি এটি পিরিয়ড মিস করার আগেও বাড়তে পারে। গর্ভাবস্থার অগ্রগতির সাথে সাথে, ক্রমবর্ধমান পরিমাণে স্রাব উৎপাদনও হতে থাকে। গর্ভকালীন সময় বাড়ার সাথে সাথে স্রাব পরিমাণে আরও বেশি হওয়ার প্রবণতা থাকে এবং এটি আরো ঘন ঘন হয়। এটি সাধারণত গর্ভাবস্থার শেষের দিকে সবচেয়ে বেশী হয়।
গর্ভাবস্থার শেষ সপ্তাহগুলোতে, যোনি স্রাবের মধ্যে ঘন শ্লেষ্মা এবং রক্তের দাগ থাকতে পারে। স্বাভাবিক যোনি স্রাব পাতলা বা পরিষ্কার দুধের মত সাদা এবং হালকা গন্ধযুক্ত। যদি গর্ভাবস্থায় স্রাব হলুদ, সবুজ বা ধূসর, একটি তীব্র, অপ্রীতিকর গন্ধযুক্ত হয় তবে এটি অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়। অস্বাভাবিক স্রাব সংক্রমণ বা গর্ভাবস্থায় সমস্যার লক্ষণ হতে পারে, বিশেষ করে যদি যোনিপথে লালচেভাব, চুলকানি বা ফোলা ভাব থাকে। সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া জরুরী।
গর্ভাবস্থার জটিলতা
- উচ্চ রক্তচাপ
- রক্তস্বল্পতা
- প্রসবকালীন বিষণ্নতা
- প্রসবোত্তর সাইকোসিস (মানসিক পরিবর্তন বেশি ঘটা। যেমন: হঠাৎ করে মন খারাপ করা বা মেজাজ খারাপ হয়ে যাওয়া)
- গর্ভকালীন ডায়াবিটিস (Gestatioonal Diabetes)
এছাড়া অতিরিক্ত বমি বমি ভাব, পালমোনারি এমবোলিজম (ফুসফুসে রক্ত জমাট বেধে যায়), ফ্যাটি লিভার (লিভারে চর্বি জমা) ইত্যাদি সমস্যাও হতে পারে।
গর্ভকালীন পরিচর্যা
মাতৃস্বাস্থ্য বলতে গর্ভাবস্থা, প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সময়ের মহিলাদের স্বাস্থ্যকে বোঝায়। প্রতিটি পর্যায় একটি ইতিবাচক অভিজ্ঞতা হওয়া উচিত, যাতে নিশ্চিত করা হয় যে গর্ভবতী মা এবং শিশুরা তাদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের পূর্ণ সাফল্য পায়।
একটি স্বাস্থ্যকর গর্ভাবস্থার ডায়েট আপনার সাধারণ স্বাস্থ্যকর খাদ্যের মতোই হওয়া উচিত, শুধুমাত্র প্রতিদিন ৩৪০ থেকে ৪৫০ অতিরিক্ত ক্যালোরি সহ যেহেতু গর্ভের শিশুর বৃদ্ধির জন্যও পর্যাপ্ত খাবার প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের বৃদ্ধি এবং সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য নিয়মিত একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। মাতৃস্বাস্থ্য সংস্থাগুলি পরামর্শ দেয় যে, গর্ভবতী মহিলাদের ৩ বার আলট্রাসাউন্ড করা উচিত যাতে ভ্রূণের সম্ভাব্য বৃদ্ধির কোন অসঙ্গতি থাকলে তা পরীক্ষা করা যায় এবং ভবিষ্যতে গর্ভকালীন জটিলতা প্রতিরোধে সঠিক ব্যবস্থা নেয়া যায়।
আল্ট্রাসাউন্ড প্রথম ট্রাইমেস্টারে একটি, দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে একটি এবং তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে একটি এভাবে করা হয়। আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে শিশুর হার্টবিট, শিশুর আকার, কোন পজিশনে আছে ইত্যাদি পরিক্ষা করে দেখা হয়। এটাও বলা হয়েছে যে গর্ভবতী মহিলাদের টিটেনাস ভ্যাকসিন এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন সহ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকাদান কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। যেসব গর্ভবতী মহিলারা প্রি-ক্ল্যাম্পসিয়ার (যাদের উচ্চ রক্তচাপ এবং শরীরের অন্য কোন অর্গান ফেইল করার সম্ভাবনা আছে।
যেমন: (কিডনী, লিভার) ঝুঁকিতে রয়েছেন, তারা গর্ভধারনের ২০ সপ্তাহের মধ্যে কম ডোজের অ্যাসপিরিন গ্রহণ করতে পারেন।
গর্ভকালীন সময়ে যে খাবারগুলো ডায়েটে রাখা প্রয়োজন-
- জটিল শর্করা
- প্রোটিন: ফিটাসের সুস্থ বৃদ্ধির জন্য প্রোটিন প্রয়োজনীয়
- শাক – সবজী ও ফল
- শস্য এবং লিগিউমস
- স্বাস্থ্যকর চর্বি
আপনি যদি আগে থেকেই স্বাস্থ্যকর খাবার খান, তাহলে আপনাকে খাবার তালিকায় কেবল সামান্য কিছু পরিবর্তন করতে হবে। গর্ভাবস্থায় তরল, ফাইবার এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ভিটামিন এবং খনিজ
গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভবতী নয় এমন মহিলাদের চেয়ে বেশি পরিমাণে কিছু ভিটামিন এবং খনিজ প্রয়োজন। ফলিক অ্যাসিড এবং আয়রন তার মধ্যে অন্যতম।
আপনি গর্ভবতী জানার পর ডাক্তারের পরামর্শে বিভিন্ন সাপ্লিমেন্টারি গ্রহণের মাধ্যমে ভিটামিন এবং খনিজের চাহিদা মেটাতে পারেন। যেকোন ওষুধ সেবনের আগে পুষ্টি লেবেলগুলি পড়তে ভুলবেন না এবং যেকোনো পরিপূরক বা ওভার-দ্য-কাউন্টার (ওটিসি) ওষুধ ব্যবহারের আগে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম
গর্ভাবস্থায় আপনাকে ফিট, আরামদায়ক এবং শ্রমের জন্য প্রস্তুত রাখতে ব্যায়াম অপরিহার্য বিশেষ করে যোগব্যায়াম এসময় আপনাকে স্থির থাকতে সাহায্য করবে।গর্ভাবস্থার জন্য অন্যান্য ভাল ব্যায়াম হল হাঁটা, এবং সাঁতার। আপনার পরিবর্তিত শরীর এবং কম শক্তির মাত্রা সামঞ্জস্য করার জন্য আপনাকে আপনার বর্তমান ফিটনেস রুটিন পরিবর্তন করতে হতে পারে। এ ব্যাপারে সহযোগিতা পেতে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
প্রতিটি নারীর জীবনেই গর্ভাবস্থার সময় টুকু অনেক বেশি আবেগঘন এবং স্বরণীয় সময়। তবে এই সময়ে একটি নারীর দায়িত্ব অনেক বেশী গুণে বেড়ে যায়। কেননা একটি সুস্থ সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে একটি গর্ভধারণ চূড়ান্ত সফলতা লাভ করে। কাজেই গর্ভবতী হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে একজন নারীর উচিত প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনার জন্য একজন দক্ষ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া ।
এই সময়টুকু তাৎপর্যপূর্ণ করতে অবশ্যই গর্ভবতী নারীর পরিবার পরিজনদের সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে বিশেষ করে গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে তার শারীরিক মানসিক সুস্থতার উপর খেয়াল রাখতে হবে।কেননা একটি সুস্থ সন্তান আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।
Last Updated on December 19, 2023
Leave A Comment