পুড়ে যাওয়া (Burns) একটি কমন ঘটনা যা যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রে হতে পারে। পুড়ে যাওয়ার ফলে নানাবিধ ঘরোয়া উপকরণ ব্যবহারের প্রচলন আমাদের দেশে অহরহ দেখা যায় যার অধিকাংশই বিজ্ঞানসম্মত নয়, বরং ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
তাই পুড়ে গেলে প্রাথমিক অবস্থায় করণীয় কি সেই সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা জরুরী। এছাড়াও প্রচলিত কোন কোন উপকরণ ব্যবহার করা যাবে না এবং কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে সেই বিষয়ে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
পুড়ে গেলে ঘরোয়া চিকিৎসা
পুড়ে যাওয়ার চিকিৎসায় কার্যকরী ঘরোয়া পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে নিচে বর্ণনা করা হলো। (Cafasso, 2023)
পানি ঢালা
যেকোনো ধরনের পোড়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ হলো পানি ঢালা। পোড়ার স্থানে ক্রমাগত পানি ঢালার ফলে পোড়ার ক্ষতের গভীরতা বেশি হওয়ার সুযোগ পায় না। একদম ঠান্ডা (ফ্রিজের পানি) বা কুসুম গরম পানি নয়, বরং স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি পোড়ার তীব্রতা অনুযায়ী ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট পর্যন্ত ঢালতে হবে।
একদম ঠান্ডা পানি ঢালা হলে তখন আরাম লাগে কিন্তু এতে ক্ষত শুকাতে দেরি হয়। আর গরম পানি ঢালা হলে ক্ষতের গভীরতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এছাড়াও পানির সাথে লবণ বা অন্য কোনো কিছু মেশানোর প্রয়োজন নেই। বরং সরাসরি টিউবওয়েল বা ট্যাপের পানি ঢালতে হবে।
এলোভেরা
প্রাকৃতিক গুণাগুণ সম্পন্ন একটি উপাদান হলো এলোভেরা যা ত্বকের যত্নে বিভিন্ন উপকারিতা বয়ে আনে। পুড়ে যাওয়া স্থানে এলোভেরা জেল ব্যবহার করা জ্বালাপোড়া কমাতে এবং ক্ষত সারাতে সহায়তা করে।
এলোভেরা পাতা থেকে জেলি সংগ্রহ করে আক্রান্ত স্থানে প্রলেপ দিয়ে রাখতে হবে। ক্ষত না শুকানো পর্যন্ত দিনে ২ থেকে ৩ বার এলোভেরা জেল ব্যবহার করা যেতে পারে।
ত্বকের যত্নে এলোভেরার উপকারিতা এবং ব্যবহারের নিয়ম সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
মধু
পোড়া স্থানে বাহ্যিকভাবে মধু ব্যবহার করা উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ মধু এন্টি-মাইক্রোবিয়াল ও এন্টি-ইনফ্লামেটরি গুণাগুণ সম্পন্ন একটি উপাদান অর্থাৎ মধু শরীরে ক্ষতিকর অণুজীবের (ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাস) সংক্রমণ প্রতিহত করতে এবং প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে।
মধুর উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
পেট্রোলিয়াম জেলি
পোড়া স্থানে ক্ষত শুকাতে দিনে ২ থেকে ৩ বার পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে জ্বালাপোড়া কমবে এবং দ্রুততম সময়ে ক্ষত শুকাতে সাহায্য করে।
রোদে কম যেতে হবে
পুড়ে যাওয়া ক্ষত শুকাতে ভিটামিন ডি এর ভূমিকা রয়েছে। আর ভিটামিন ডি পাওয়ার জন্য ত্বকে সূর্যরশ্মি লাগানোর প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু পুড়ে যাওয়া স্থানে রোদের তাপ লাগলে জ্বালাপোড়া হতে পারে।
তাই রোদ পোহানোর সময় পোড়া স্থান কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এছাড়াও কাজের জন্য রোদে যাওয়ার প্রয়োজন হলে যতটা সম্ভব কাপড় দিয়ে শরীর ঢেকে নিতে হবে।
সূর্যরশ্মি ছাড়াও মাছ, ডিম, দুধ, মাশরুম, পনির ইত্যাদি খাবার থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।
ফোস্কা গলানো যাবে না
পুড়ে যাওয়া স্থানে ফোস্কা উঠে যা অনেকেই গলানোর চেষ্টা করেন। এটি একটি অনুচিত কাজ। ফোস্কা গলানো যাবে না কারণ এতে ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। ফোস্কা আপনাআপনি গলে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
ক্রিম
পুড়ে যাওয়া স্থানে Silver sulfadiazine ক্রিম ব্যবহার করা হলো সবচেয়ে উত্তম উপায়। বাজারে যেসব নামে এই ক্রিমটি কিনতে পাওয়া যায় তা হলোঃ (MedEx, n.d.)
- Bentol®
- Burna®
- Burnsil®
- Neozine®
- Sibalyn®
- Silcream®
- Silvec®
- Silverax®
- Silzin®
- Silverzine®
এই ক্রিমটি কিনে ঘরে রেখে দেওয়া উচিত যেন পুড়ে গেলে ক্ষতস্থানে দ্রুত লাগানো সম্ভব হয়। এটি দামে বেশ সস্তা এবং যেকোনো ফার্মেসিতে কিনতে পাওয়া যাবে।
ওষুধ
পুড়ে যাওয়ার ফলে ব্যথা ও জ্বালাপোড়া হলে আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) ওষুধটি খাওয়া উপকারী হতে পারে। এটি একটি ওটিসি মেডিসিন যা চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়াই সেবন করা যায়।
Advel®, Alflam®, Arafa®, Flamex®, Inflam®, Profen®, Reufen®, Siflam® ইত্যাদি নামে আইবুপ্রোফেন কিনতে পাওয়া যায় যা ৪০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় দিনে ২ থেকে ৩ বার ভরাপেটে সেবন করতে হবে।
খাবার
আগুনে পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থান শুকানোর জন্য শরীরে প্রোটিন জাতীয় খাবারের চাহিদা বেড়ে যায়। কারণ প্রোটিন শরীরের ক্ষয়পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, বাদাম, মটরশুটি, ডাল সহ সবধরনের পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
তবে এলার্জিক খাবার খাওয়া যাবে না। কারণ এতে পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানে চুলকানি হতে পারে।
পুড়ে গেলে যেসব জিনিস ব্যবহার করা যাবে না
পুড়ে যাওয়া স্থানে এমন অনেক উপকরণ লাগানোর প্রচলন রয়েছে যেগুলো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে না। এমনকি কোনো কোনোটি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। যেসব উপকরণ পুড়ে গেলে ব্যবহার করা যাবে না তা নিচে তুলে ধরা হলো।
ডিমের সাদা অংশ
পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানে ডিমের সাদা অংশ লাগানো বহুল প্রচলিত একটি পদ্ধতি। এতে সাময়িকভাবে জ্বালাপোড়া লাঘব হলেও এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ কাঁচা ডিমে ব্যাকটেরিয়া থাকে যার ফলে ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হতে পারে। তাই পুড়ে গেলে ডিম ভেঙে ব্যবহার করা যাবে না।
মাখন
পুড়ে যাওয়া স্থানে মাখন ব্যবহার করা হলে ক্ষত শুকাতে সাহায্য করবে এবং দাগ হবে না এই ধারণা থেকে অনেক মানুষ মাখন ব্যবহার করে থাকেন যা সম্পূর্ণ ভুল পদ্ধতি। পুড়ে যাওয়ার পর মাখন ব্যবহার করা হলে ক্ষতের গভীরতা বেড়ে যাওয়া সহ ক্ষতিকর অণুজীবের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর তাই মাখন ব্যবহার করা যাবে না।
তেল
নারিকেল তেল বা অলিভ অয়েল ত্বকের যত্নে বিভিন্ন উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। তবে পুড়ে যাওয়া স্থানে তেল ব্যবহার করে কোনো উপকার আশা করা যায় না। তাই পুড়ে গেলে কোনো ধরনের তেল ব্যবহার করা যাবে না।
টুথপেস্ট
পুড়ে গেলে অনেকেই টুথপেস্ট বাহ্যিকভাবে প্রলেপ দিয়ে রাখেন যা সাময়িকভাবে জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে বলে মনে হলেও এটি অনুচিত একটি কাজ। কারণ টুথপেস্ট লাগানোর ফলে ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর তাই পুড়ে যাওয়া স্থানে টুথপেস্ট লাগানো যাবে না।
বরফ
পুড়ে গেলে ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে ক্ষতস্থানে ঠান্ডা সেঁক দেওয়ার প্রচলন দেখা যায়। এতে করে সাময়িকভাবে জ্বালাপোড়া ও ব্যথা কমে যায় কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ভালো নয়। পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানে বরফ লাগানো হলে ক্ষত শুকাতে দেরি হয়।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
ত্বকের সামান্য অংশ পুড়ে গেলে সেক্ষেত্রে ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করাই যথেষ্ট হবে। তবে খুব বেশি জায়গা জুড়ে পুড়ে গেলে বা গভীর পোড়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে পানি ঢালতে হবে এবং ভেজা কাপড় পেচিয়ে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
রাসায়নিক উপাদানের দ্বারা বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পুড়ে গেলে জরুরি ভিত্তিতে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও মৃদু প্রকৃতির পোড়ার ক্ষেত্রে এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ক্ষত না শুকালে বা পোড়ার স্থানে ইনফেকশন দেখা দিলে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
References
Cafasso, J. (2023, February 07). Home Remedies for Burns. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/home-remedies-for-burns
MedEx. (n.d.). Silver sulfadiazine. Retrieved from MedEx: https://medex.com.bd/generics/986/silver-sulfadiazine/brand-names
Last Updated on November 11, 2023
Leave A Comment